মহানবী সাঃ এর জীবনী । Mohammad: The Final Legacy. Ep-09

আসসালামু আলাইকুম, প্রিয় পাঠক আজকের আর্টিকেল এর মাধ্যমে আমি আপনাদের সাথে শেয়ার করবো মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর সম্পুর্ন জীবনী বাংলা সিরিজ আর্টিকেল  এর  ৯ম পর্ব সম্পর্কে। আপনি যদি 'মহানবী সাঃ এর সম্পুর্ন জীবনী' এই সিরিজ আর্টিকেলে নতুন হয়ে থাকেন এবং ৮ম পর্বটি পড়তে চান তাহলে এখানে ক্লিক করে আগের পর্বটি পড়ে নিতে পারেন। চলুন আজকের পর্ব শুরু করা যাক-

 প্রাথমিক মুসলমানদের বিশেষত 

"ইসলাম তরবারি বলে বিস্তার লাভ করেছে।" এই বলে ইসলামের শত্রুগণ বিশেষতঃ ইউরোপীয় পণ্ডিতগণ সর্বদাই ইসলামের প্রতি কলঙ্ক আরোপ করার চেষ্টা করে আসতেছেন। সুতরাং "ইসলাম কিরূপে বিস্তার লাভ করল।" এটা ইসলামী ইতিহাসের একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়েছে। এজন্য আমরা আমাদের পাঠক পাঠিকাদেরকে গোড়া হতেই এ বিষয়টির প্রতি বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি। ইসলাম যখন আত্মপ্রকাশ করল তখন যাঁরা তাকে সাদরে গ্রহণ করেছিলেন, তাঁরা যে কি প্রকৃতির লোক ছিলেন, আর যারা ইসলামের বিরুদ্ধাচরণ করেছিল তারাই বা কি ধরনের লোক ছিল, মোটামুটি তা অবগত হওয়া আবশ্যক।

যাঁরা সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ করলেন তাঁদের প্রত্যেকেই ছিলেন সত্যান্বেষী চরিত্রবান এবং সৎলোক। যথাঃ হযরত উসমান বিন মায'উন (রাঃ) ইনি মুসলমান হবার পূর্বেই মদ্য পান বর্জন করেছিলেন। মুসলমান হবার পরেও সংসার ত্যাগ করে বৈরাগ্য অবলম্বনের ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু রাসূল (সাঃ) তাঁকে এর অনুমতি দেন নি। হযরত সুহায়ব (রাঃ) ও তাঁর ন্যায় ইসলাম গ্রহণের পূর্বেই মদ্য পান পরিত্যাগ করেছিলেন।

Ideal biography of the Prophet Muhammad
মহানবী হযরত মুহাম্মদ সঃ এর আদর্শ জীবন কাহিনী 

হযরত আবু যর মুসলমান হবার পূর্বেই পৌত্তলিকতা ছেড়ে দিয়ে অদ্বিতীয় আল্লাহর উপাসনা করা এবং নামায পড়া আরম্ভ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু কিরূপে আল্লাহর ইবাদত করবেন বা নামায পড়বেন, তা স্থির করতে না পেরে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন চিত্তে কাল যাপন করতেছিলেন। রাসুল (সাঃ)-এর সংবাদ শুনতে পেয়ে তিনি খোঁজ নিবার জন্য তাঁর ভাইকে পাঠিয়ে দিলেন। মক্কা হতে প্রত্যাবর্তন করে তাঁর ভ্রাতা তাঁকে জানালেন, "লোকেরা মুহাম্মদ (সাঃ)-কে মুর্তাদ বলে মনে করে। কিন্তু তিনি লোকদেরকে অতি উচ্চ ধরনের শালীনতা ও সভ্যতা শিক্ষা দেন। তিনি লোকদেরকে যে বাণী পড়ে শুনান, তা কবিতা নয়। হে ভাইজান, আপনার ধর্ম পদ্ধতি তাঁর সাথে অনেকটা খাপ খায়।

এই সংবাদ শুনে হযরত আবু যর বিচলিত হয়ে উঠলেন। তিনি তৎক্ষণাৎ রওয়ানা হয়ে রাসূল (সাঃ)-এর খিদমতে হাযির হলেন এবং তাঁর মুখের পবিত্র বাণী শ্রবণ করে ইসলাম গ্রহণ করলেন।

তিনি মুসলমান হবার পর আজীবন পার্থিব ঝঞ্ঝাট হতে স্বতন্ত্র থেকে আল্লাহর 'ইবাদতে মগ্ন ছিলেন। যেহেতু মানব জীবনের উদ্দেশ্য পরকালের শান্তি লাভ করা, এজন্য কোন মুসলমানের অর্থ সঞ্চয় করে রাখা তিনি জায়িয মনে করতেন। না। তাই হযরত "উসমান (রাঃ) তাঁর খিলাফতকালে হযরত আবু যর (রাঃ)-কে মদীনা হতে দূরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।

প্রাথমিক মুসলিমমণ্ডলীর মধ্যে অনেকে এমনও ছিলেন যাঁরা মুসলমান হবার পূর্বে নিজকে নিজে হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-এর অনুসারী বলে মনে করতেন। কিন্তু হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-এর শরী'আত কি রূপ ছিল তা কিছুই জানতেন না। এজন্য সত্য ধর্মের অন্বেষণে তাঁরা দেশ-বিদেশে ভ্রমণ করতেন। অন্ধ যুগের প্রসিদ্ধ একত্ববাদী যায়দও এই দলের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তিনি পবিত্র ইসলামের আত্মপ্রকাশ করার পূর্বেই পরলোক গমন করেন, কিন্তু তাঁর পুত্র হযরত সা'ঈদ (রাঃ) রাসূল (সাঃ)-এর খিদমতে উপস্থিত হয়ে বুঝতে পারলেন যে, যেই সত্য এবং যেই মহাপুরুষের অনুসন্ধান করতে করতে তাঁর পিতা পরলোক গমন করলেন, ইনিই সেই মহাপুরুষ এবং ইসলামই সেই সত্য। সুতরাং তৎক্ষণাৎ তিনি মুসলমান হয়ে গেলেন। তাঁর সাথে তাঁর স্ত্রী হযরত ফাতিমাও ইসলাম গ্রহণ করলেন। এই ফাতিমা হযরত 'উমরের ভগ্নি ছিলেন।

নওমুসলিমদের মধ্যে অধিকাংশই অল্প বয়স্ক ছিলেন। এঁদের মধ্যে অনেকের বয়সই বিশ বছরের কম ছিল। তাঁদের অভিভাবকগণ ছিল ইসলামবিরোধী কাফির। এজন্য তাঁরা নিজেদের মুসলমান হবার কথা গোপন রাখতে চেষ্টা করতেন।

এই অগ্রবর্তী মুসলিম দলের কেউ কোন বড় পদ বা সরদারীর অধিকারী ছিলেন না। এঁদের অধিকাংশই ছিলেন দীন-দরিদ্র। এঁদের মধ্যে অনেকে পরাধীন দাসও ছিলেন; যেমন-হযরত 'আম্মার, হযরত খাব্বার, হযরত আবূ ফুকায়হা, হযরত সুহায়ব প্রমুখ। মক্কার ধনকুবের ও নেতাদের দরবারে এঁদের কোন মর্যাদা ছিল না। বিপদে তাঁদের কেউ সহায় ছিল না। সমাজে তাঁরা ছিলেন লাঞ্ছিত ও পদদলিত। এজন্যই তাঁরা যখন রাসূল (সাঃ)-এর দরবারে বসতেন তখন কুরায়শ সরদারগণ উপহাস করে বলত- "তোমাদেরকে বাদ দিয়ে আল্লাহ্ তা'আলা কি এদের প্রতিই মেহেরবানী করলেন?

কাফিরগণ মনে করত যে, দরিদ্রতাই হেয় ও ঘৃণ্য হবার কারণ। বস্তুতঃ এ দরিদ্রতাই তাঁদের জন্য সর্বোচ্চ মর্যাদা লাভের কারণ হয়েছিল। আল্লাহ ও রাসূলের দরবারে তাঁদের যে মর্যাদা, নিখিল বিশ্বে তার কোন তুলনা আছে কি? ধন দৌলতের গৌরব মানব-হৃদয়ে আত্মম্ভরিতা ও দাম্ভিকতা জন্মায়ে দেয়। অতএব ধনসম্পত্তির অধিকারী হলে মানুষ সহজে সত্যের সম্মুখে মস্তক অবনত করতে পারে না। সুতরাং সত্যের আলো হতে বঞ্চিত থেকে সে চির অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে ধ্বংস প্রাপ্ত হয়। আর দরিদ্রের হৃদয় সম্পদ-লালসা, প্রতিপত্তি-প্রিয়তা, অহংকার প্রভৃতি কলুষ-কালিমা হতে সম্পূর্ণ পবিত্র থাকে। অতএব অভ্যুদয়ের সাথে সাথেই সত্য-রবির উজ্জ্বল আলোতে তার অন্তর উদ্ভাসিত হয়ে উঠে এবং এইপবিত্র আলোর কল্যাণে সে অনন্ত সুখের জীবন লাভ করতে এবং আল্লাহর প্রদত্ত অফুরন্ত নেয়া'মতের অধিকারী হতে সক্ষম হয়।

এজন্য সর্বদাই দরিদ্রগণ আল্লাহর প্রেরিত মহাপুরুষদের প্রথম অনুসরণকারী হন। দরিদ্র মৎস্য শিকারী জেলেগণই সর্বপ্রথম হযরত 'ঈসা (আঃ)-এর নবুওয়তের প্রতি ঈমান এনেছিলেন। যাঁরা হযরত নূহ (আঃ)-এর বিশিষ্ট সহচর ছিলেন তাঁদের সম্বন্ধেই কাফিরগণ বলেছিলেন-

"আর আমরা দেখতেছি যে, যারা নীচ সম্প্রদায়ের লোক তারাই আপনার অনুগত হয়েছে।

আবুল আরকমের পুত্র হযরত আরকম (রাঃ) এগার জনের পর পবিত্র ইসলাম গ্রহণ করেন। সাফা পাহাড়ের পাদদেশে তাঁর বাসস্থান ছিল। সেখানে বসেই রাসূল (সাঃ) গোপনে নওমুসলিমদেরকে শিক্ষা দিতেন।

সত্যের আকর্ষণে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে যাঁরা তাঁর খিদমতে উপস্থিত হতেন তাঁদেরকেই তিনি ইসলামে দীক্ষিত করতেন। যে পরিমাণ কুরআন মজীদ অবতীর্ণ হত, সাথে সাথেই তিনি তা তাদেরকে মুখস্থ করিয়ে দিতেন। যাঁরা এখনও ইসলামের সন্ধান পান নি, তাঁদের নিকেট নওমুসলিমগণ আল্লাহর প্রশংসা, তাঁর অসীম কুদরত এবং তাঁর মহত্ত্ব ও গুণাবলী সংবলিত আয়াতসমূহ পাঠ করলে তাঁরা আল্লাহর প্রেমে প্রমত্ত হয়ে উঠতেন এবং চুপে চুপে হযরত আরকামের বাড়ীতে গমনপূর্বক ইসলাম গ্রহণ করতেন। অতি সন্তর্পণে ও গোপনে প্রচার কার্য চলতে লাগল।

সত্যের কি অলৌকিক আকর্ষণ। ধন-সম্পত্তি, স্ত্রী, পুত্র, সব কিছুর মমতা ত্যাগ করেই তখন ইসলাম গ্রহণ করতে হত। কোন মূহূর্তে যে রক্তপিপাসু কুরায়শ সরদারগণ সন্ধান পেয়ে নওমুসলিমদেরকে সর্বস্বান্ত করে ফেলে, তা কে বলবে? এতদসত্ত্বেও এই দুর্বল দরিদ্র মুসলমানদের ঈমান যে কত অটল ছিল, তা পরবর্তী ঘটনাবলী হতে জানতে পারা যাবে। কুরায়শদের হুমকি ভীতি প্রদর্শন, অমানুষিক অত্যাচার, ধন-দৌলতের লোভ দেখানো ইত্যাদি কোন কিছুই তাঁদেরকে লক্ষ্য ভ্রষ্ট করতে পারে নি। এজন্যই অতি অল্প সময়েই এই নিঃসহায় দুর্বলদের পদতলে কায়সার ও কিসরার ন্যায় শক্তিশালী সম্রাটগণও মস্তক অবনত করতে বাধ্য হয়েছিলেন।

পাঠক, তখন যাঁরা ইসলামে দীক্ষিত হলেন, তাঁরা কি তরবারির ভয়ে এত সন্তর্পণে হযরত আরকামের বাড়ীতে যেতেন? তরবারির ভয়, কোন প্রকার শক্তি প্রয়োগ বা প্রলোভন কোনকিছুই ছিল না। ছিল শুধু সত্য ও ন্যায়ের আকর্ষণ। এই আকর্ষণেই সত্যানুসন্ধিৎসু মহাত্মাগণ আত্মীয় বিচ্ছেদ, বন্ধু, বিরহ, পুরুষানুক্রমিক ধর্ম বর্জন, কুরায়শ-সরদারদের অত্যাচার-এসব বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বিপদকে হেলায় উপেক্ষা করে আনন্দের সাথে ইসলামের পতাকা তলে সমবেত হতেছিলেন। এরূপে তিনবৎসর পর্যন্ত রাসূল (সাঃ) হযরত আরকমের বাড়ীতে বসে গোপনে গোপনে প্রচারের কর্তব্য পালন করতে থাকলেন।

 নবুওয়তের চতুর্থ বছর 

প্রকাশ্য প্রচারের আদেশ:

মহানবী (সাঃ)-এর নবুওয়তের তিন বছর অতীত হয়ে গেল। এখন রিসালতের সূর্য সত্যাকাশের খানিকটা উচ্চে আরোহণ করেছে। তার কিরণ ক্রমান্বয়ে সতেজ ও উজ্জ্বল হতে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠেছে। তাই বিশ্বনিয়ন্তা সর্বজ্ঞ রহমানুররহীম আল্লাহ তা'আলার দরবার হতে রাসূল (সাঃ)-এর প্রতি প্রকাশ্যভাবে স্পষ্টাক্ষরে মহাসত্য প্রচার করার জন্য নির্দেশ এসে পৌঁছল-

"অপিচ আপনার প্রতি যে নির্দেশ দেয়া হয়, আপনি তা স্পষ্টরূপে শোনায়ে দিন।"

"আর আপনি নিজের ঘনিষ্ট আত্মীয়বর্গকে (আল্লাহর) ভয় প্রদর্শন করুন।"

আল্লাহর নির্দেশ পেয়ে রাসূল (সাঃ) ব্যাপকভাবে সর্বসাধারণকে এবং বিশেষভাবে নিজের আত্মীয়স্বজনকে আল্লাহর মনোনীত সত্যধর্ম গ্রহণের জন্য মুক্ত আহ্বান জানাতে প্রস্তুত হলেন।

'আরবের চিরাচরিত নিয়ম ছিল, শত্রুদের অতর্কিত আক্রমণ কিংবা অন্য কোন ভীষণ বিপদের আশঙ্কা দেখা দিলে অথবা কেউ সমাজের নিকট কোন গুরুতর বিষয়ের প্রতিবাদ জানাতে হলে, সে পাহাড়ের উপর আরোহণ করত নির্দিষ্ট কয়েকটি সাঙ্কেতিক শব্দ উচ্চারণ করে উচ্চঃস্বরে চীঃকার করতে আরম্ভ করত। এই চীৎকার শুনা মাত্র সকলেই দৌড়ে যেয়ে তথায় উপস্থিত হত। বিশেষ কোন কারনে কেউ যেতে না পারলে তার পরিবর্তে তার স্কুলভিষিক্ত কোন ব্যক্তিকে পাঠাতে বাধ্য হত।

রাসূল (সাঃ) প্রকাশ্য প্রচারের জন্য সাফা পাহাড়ের উচ্চ শিখরে আরোহণ করলেন এবং আরবের প্রথানুযায়ী নামে নামে কুরায়শের সকল গোত্রকে আহ্বান করলেন। তাঁর এই গুরুগম্ভীর আহ্বানের করুণ ধ্বনি মক্কার গৃহে গৃহে প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠল। মক্কাবাসিগণ দৌড়ে এসে সাফার পাদদেশে সমবেত হল।

তিনি সমবেত জনমণ্ডলীকে সম্বোধণ করে বললেন, "হে কুরায়শগণ আমি যদি তোমাদেরকে বলি যে, এই পর্বতের পিছনে শত্রুদের এক প্রবল সৈন্যবাহিনী তোমাদেরকে আক্রমণ করার জন্য এবং তোমাদের ধন-সম্পদ সর্বস্ব লুন্ঠন করে নিয়ে যাবার জন্য অপেক্ষা করতেছেন, তবে তোমরা কি এ-কথা বিশ্বাস করবে? সকলে সমস্বরে বলে উঠল, নিশ্চয়, আমরা আপনার কথা বিশ্বাস করব। আপনাকে কখনও মিথ্যা কথা বলতে শুনি নি। আপনি আমাদের 'আলআমীন"। আপনি যা বলবেন তাঁ নিশ্চয়ই সত্য হবে।"

রাসূল (সাঃ) জলদ গম্ভীরস্বরে বললেন, "তোমরা যখন আমাকে সত্যবাদী বলে বিশ্বাস কর তখন শুন, তোমরা যদি আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন না কর তবে তোমাদের উপর কঠোর আযাব নাযিল হবে। আমি তোমাদেবকে আসন্ন আযাব ও অবশ্যম্ভাবী ধ্বংস হতে সর্তক করতেছি। তোমরা আল্লাহর প্রতি ঈমান না আনলে কিছুতেই সেই আযাব হতে মুক্তি লাভকরতে পারবে না। তোমাদের হাতে গড়া দেবতাসমূহ তোমাদেরকে আল্লাহর শাস্তি হতে রক্ষা করতে সক্ষম হবেন না। তোমরা সৃষ্টসেরা মানব, আর এই দেবতাসমূহ তোমাদের হাতে গড়া নিকৃষ্ট জড় পুতুল। সুতরাং এরা তোমাদের উপাস্য হতে পারে না।

বিশ্ব চরাচরের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তা'আলাকে তোমরা এক বলে বিশ্বাস কর এবং একমাত্র তাঁরই 'ইবাদত কর। তাঁকে ছাড়া আর কেউ 'ইবাদতের যোগ্য নেই। আমি তোমাদেরকে এই নির্ভুল পথ প্রদর্শনের জন্য আদিষ্ট হয়েছি। ভ্রাতৃগণ, সত্যই তোমরা এক দল শয়তানী ফৌজের কবলে পড়েছ। এই পরাক্রমশালী শত্রুবাহিনী তোমাদেরকে গ্রাস করতে বসেছে। আল্লাহ বিস্মৃতি, কাপট্য, লাম্পট্য, অত্যাচার, ব্যভিচার এবং আরও শত প্রকারের পাপ ও কলুষতা তোমাদেরকে অবরোধ করে বসেছে। হে ধ্বংসমুখ সমাজ এখনও সময় আছে, আল্লাহর ডাকে সাড়া দাও। লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু বলে একত্বের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন কর।

এই কথা শুনে সমবেত জনতামণ্ডলীর মধ্য হতে রাসূল (সাঃ)-এর চাচা 'আবদুল মুত্তালিবের পুত্র আবু লহব ক্রুদ্ধ করে বলে উঠল।

"তোমার সর্বনাশ হউক, এই জন্যই বুঝি তুমি আমাদেরকে সমবেত করেছিলে?" এই বলে গালাগালি করতে করতে আবূ লহব ও সমবেত লোকগণ প্রস্থান করল। আবু লহবের এই অসদ্ব্যবহারের প্রতিউত্তরেই সূরা লহব অবতীর্ণ হয়েছিল। এবং পরিমাণে তাকে মারাত্মক প্লেগ রোগে আক্রান্ত হয়ে অপমৃত্যু বরণ করতে হয়েছিল।

এই আহ্বানে আপাততঃ বিশেষ কোন সুফল দেখা যায় নি। কিন্তু এই বক্তৃতার ফলে মক্কার ঘরে ঘরে হযরতের শিক্ষা এবং উপদেশ সম্বন্ধে নানা প্রকার আলোচনা ও আন্দোলন হতে লাগল। হাটে-ঘাটে, পথে-প্রান্তরে সর্বত্র আল্লাহ ও রাসূলের কথা আলোচনা হতে লাগল। বিরোধ ও অস্বীকৃতির মধ্য দিয়েই ইসলামের বাণী দিকে দিকে প্রচারিত হতে লাগল।

এই ঘটনার কিছু দিন পরে রাসূল (সাঃ) হযরত 'আলী (রাঃ)-কে একটি ভোজসভার আয়োজন করার জন্য নির্দেশ দিলেন। বস্তুতঃ নিজের ঘনিষ্ঠ বংশধরগণকে প্রকাশ্যভাবে ইসলামের প্রাথমিক আহ্বান জানাবার উদ্দেশ্যেই এই সম্মিলনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সমস্ত বনু 'আবদিল মুত্তালিবকে দা'ওয়াত করা হল। খাজা আবু তালিব, হযরত হামযা, হযরত 'আব্বাস প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ সকলেই যথাসময়ে উক্ত সম্মিলনে যোগদান করলেন। আহারপর্ব সমাপ্তির পর রাসূল (সাঃ) সমবেত জনমণ্ডলীকে লক্ষ্য করে বললেনঃ "হে আমার বংশধরগণ আমি আপনাদের জন্য ইহ ও পরকালের এমন কল্যাণ নিয়ে আগমন করেছি যা আরবে কোন ব্যক্তি তার স্বজাতির জন্য কোন দিনই আনয়ন করে নি। আমি আল্লাহর আদেশে আপনাদেরকে সেই কল্যাণের দিকে আহ্বান করতেছি। সত্য প্রচারের এই মহাসাধনায়, কর্তব্য পালনের এই কঠোর পরীক্ষায়, কে আমার সাহায্য করবেন? কে আমার সাথী হবেন? আসুন।"

কেউ কোন সাড়া দিল না, সকলেই নীরব নিস্তব্ধ হয়ে রইল। সভার এক প্রান্ত হতে হযরত 'আলী (রাঃ) দাঁড়ায়ে বললেন, যদিও আমি চক্ষু রোগাক্রান্ত অল্প বয়স্ক জীর্ণ শীর্ণ বালক, তথাপি আমি এই মহব্রেত পালন করার জন্য প্রস্তুত আছি। কি আশ্চর্য ব্যাপার। কি অভাবনীয় কাণ্ড। একা একজন মানুষ সারা দুনিয়ার বিরুদ্ধে একটা প্রস্তাব করেন, আর তের বছর বয়স্ক বালক তাঁর সমর্থন করেন। সভার সমস্ত লোক হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইল। আবার কেউ বিদ্রূপের হাঁসি হাঁসল। কেউ কেউ ধৃষ্ঠতা ও বাতুলতা মনে করে ক্রোধান্বিত হয়ে তাঁদের প্রতি কটাক্ষপাত করল এবং শ্লেষব্যঞ্জক বক্রোক্তি করতে করতে সভা হতে প্রস্থান করল। কিন্তু কিছু দিন পর সারাবিশ্ব স্বীকার করতে বাধ্য হল যে, যেই প্রস্তাব সর্মথনের প্রতি বিদ্রূপ করা হয়েছিল, তা ছিল সম্পূর্ণ যথার্থ এবং ধ্রুব সত্য।

এই সমস্ত ঘটনার পরে এবিষয়ে কুরায়শদের মধ্যে একটা আন্দোলন দেখা দিল। সকলের মধ্যেই একটা চাঞ্চল্যের ভাব পরিলক্ষিত হতে লাগল। রাসূল (সাঃ)-এর প্রতি তারা মনে মনে খুব চটে উঠল। সুযোগ বুঝে আবু লাহাবও দল পাকাতে আরম্ভ করল।

কিন্তু ধৈর্যের অটল পাহাড় মহানবী (সাঃ) এতে বিন্দুমাত্রও বিচলিত হলেন না। দিন দিন তাঁর উদ্যম ও উদ্দীপনা বৃদ্ধি পেতে লাগল। আত্মবিশ্বাসহীন কপট ব্যক্তি কিংবা দুর্বলচেতা কর্মী অকৃতকার্যতার প্রথম আঘাতেই নিরাশ ও কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়ে। কিন্তু যাঁরা অনাবিল সত্য নিয়ে কর্মক্ষেত্রে যোগদান করেন, অটল আত্মবিশ্বাস নিয়ে কর্তব্য পালনে রত হন। তাঁরা অকৃতকার্যতায় বিন্দুমাত্রও বিচলিত বা সম্ভ্রস্ত হন না। কারণ, সত্যের জয় অনিবার্য, আজ হউক, কাল হউক বা দুদিন পরেই হোক, সত্য যে একদিন জয়ী হবে এবং সাফল্যের কীর্তিসৌধ যে অকৃতকার্যতার ভিত্তির উপরই প্রতিষ্ঠিত হবে, এ কথার প্রতি তাঁদের অটল বিশ্বাস থাকে। অকৃতকার্যতা যতই আধিক আঘাত হানবে, সত্যের সেবক কর্মবীর মহাত্মগণের সাহস, উদ্যম ও উদ্দীপনা ততই বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হতে থাকবে। সৃষ্টসেরা মহামানব হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সাঃ)-এর পবিত্র জীবন এর পূর্ণতম আদর্শ। তিনি শত্রুদের রক্তলোচন ও রোষদৃষ্টিকে উপেক্ষা করে প্রবলভাবে প্রচার চালায়ে যেতে লাগলেন।

 সংঘর্ষের সূত্রপাত 

এতদিন পর্যন্ত রাসূল (সাঃ) সন্তর্পণে প্রচার কার্য চালাতেছিলেন। ক্রমশঃ সত্যের সেবক মুসলমানগণের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেতেছিল। এখন তাঁদের সংখ্যা চল্লিশের উপর। এই সময় পবিত্র কা'বা গৃহের প্রতি তাঁর দৃষ্টি পড়ল। এই পবিত্র গৃহে আজ তওহীদের নামগন্ধও নেই। এর অভ্যন্তরে তওহীদের পরিবর্তে শিরক সিংহাসন পেতে বসে আছে; আল্লাহর পরিবর্তে পাষাণ-বিগ্রহের পূজা চলতেছে। অথচ এই কা'বা ঘর তাঁরই ঊর্ধ্বতন পূর্বপুরুষ হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর নির্মিত। হযরত ইবরাহীম (আঃ) অংশীবাদ ও বহুত্ব ধ্বংস করে একত্ববাদ প্রতিষ্ঠার জন্য পাপিষ্ঠ রাজা নমরূদের আমলে দেব-মূর্তির মাথায় কুঠারঘাত করে তিনি অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। এতদসত্ত্বেও তিনি একমাত্র ওয়াহদাহু লা শারীকা লাহু আল্লাহ তাআলার 'ইবাদতের জন্য এই ঘর নির্মাণ করেছিলেন। আর আজ এক মুহূর্তের তরে এই ঘরে আল্লাহর নাম উচ্চারিত হচ্ছে না। এ কত বড় যুলুম। এই মূর্তিসমূহ এই ঘর হতে অপসারিত করতেই হবে। যখনই হউক, যে প্রকারেরই হউক, শিরকের কবল হতে এই পবিত্র ঘরকে উদ্ধার করতেই হবে। যে উদ্দেশ্যে এই ঘর নির্মিত হয়েছিল, আজ অন্তঃপক্ষে সেই বিস্মৃত-পূর্ব তওহীদের পবিত্র বাণী এই ঘরে ঘোষণা করা হবে। তাই তিনি আল্লাহর ঘরের হারামে মুহতারামে প্রবেশ করে জলদ গম্ভীর স্বরে ঘোষণা করলেন।

"আল্লাহ তাআলা ব্যতীত অন্য কেউ 'ইবাদতের যোগ্য নয় এবং মুহাম্মদ মুস্তফা (সাঃ) আল্লাহর প্রেরিত মহাপুরুষ।"

এই বিস্তৃত-পূর্ব পবিত্র বাণীর কল-নিনাদের মধুর কঙ্কারে সারা হারাম শরীফ মুখরিত হয়ে উঠল। দেব-মূর্তিগুলো যেন থরথর করে কেঁপে উঠল।

ব্যাপার কি। কুরায়শদের বুঝতে বিলম্ব হল না। দেব-মন্দিরের এত বড় অপমান। দেবতাদের সম্মুখেই তাদের এত বড় বে-ইজ্জতী। এটা কি সহ্য করা যায়? চতুর্দিক হতে মার মার করে কুরায়শগণ দলে দলে ছুটে আসতে লাগল। হারাম শরীফ লোকে লোকারণ্য হয়ে গেল। সকলে রাসূল (সাঃ)-কে বেষ্টন করে তিরস্কার করতে লাগল এবং তাঁকে আক্রমণ করার জন্য উদ্যত হল।

 প্রথম শহীদ 

রাসূল (সাঃ)-এর ঘরে পালিত, হযরত খাদীজার পূর্বস্বামী আবু হালার ওঁরস জাত পুত্র, তরুণ যুবক হযরত হারিস (রাঃ) এই বাড়ীতে ছিলেন। এই ঘটনার সংবাদ পেয়ে তিনি দৌড়ে এসে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলেন এবং রাসূল (সাঃ)-কে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে কুরায়শদেরকে বাধা দিতে অগ্রসর হলেন। ফলে সত্যের সেবক তরুণ যুবক হারিস সেখানেই শত্রুর হাতে শহীদ হলেন। (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন) ইনিই প্রথম শহীদ।

এখানে সত্যের সাথে মিথ্যার সংঘর্ষ আরম্ভ হল। প্রথম দিনেই সত্যের সেবক, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের একজন অকৃত্রিম ভক্ত আল্লাহর নামে রক্ত দান করলেন। পথভ্রষ্টদেরকে পথে আনার জন্য এবং ধ্বংস-পথের যাত্রীদেরকে রক্ষা করার জন্য ইসলামের সেবকগণ চিরদিনই এভাবে অম্লান বদনে রক্ত দান করে গেছেন। ইসলামের বিস্তার, এবং তার প্রতিষ্ঠার ইতিহাস তার ভক্তগণের রক্ত দ্বারাই লিখিত হয়েছে। সত্য কথা এই যে, তরবারির বলে নয়, বরং তরবারিতলেই ইসলাম বিস্তার লাভ করেছে।

 একটি সন্দেহের মীমাংসা 

রাসুল (সাঃ)-এর জীবনচরিত অধ্যয়নকালে স্বতঃই পাঠকের মনে এই সন্দেহ জেগে উঠবে যে, তিনি হলেন সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রেরিত পয়গম্বর। আবার আল্লাহ তা'আলা তাঁর তত্ত্বাবধান এবং রক্ষণাবেক্ষণের ভারও গ্রহণ করেছেন। সুতরাং আল্লাহ তা'আলা ইচ্ছা করলেই দুনিয়ার সকল মানুষকে তাঁর রাসূলের কথা মেনে নিয়ে বাধ্য করতে পারতেন অথবা শত্রুদেরকে প্রথম দিকেই পরাস্ত করে তাঁর রাসূলকে জয়ী করে দিতে পারতেন। তবে কেন রাসূল (সাঃ) কখনও বা চুপে চুপে সত্য প্রচার করেন, আবার কখনও বা সত্য প্রচারের জন্য অন্য কোন কৌশল অবলম্বন করেন। কোন সময় শত্রুর উপহাস ও তিরস্কার সহ্য করেন, আবার কোন সময় আক্রান্ত হয়ে আপন প্রিয় জনের রক্ত দিতে বাধ্য হন।

বাস্তবিক আল্লাহ্ তা'আলা সর্বশক্তিমান এবং মুহাম্মদ মুস্তফা (সাঃ) তাঁর রাসূল এবং প্রিয় বন্ধু। তিনি যা প্রার্থনা করেন আল্লাহ্ তা'আলা তাই কবুল করেন। কিন্তু দুনিয়া হল মানুষের পরীক্ষাগার। এজন্যই আল্লাহ তা'আলা মানুষকে দুনিয়াতে ভাল-মন্দ, পাপ-পুণ্য সবকিছু করার ক্ষমতা দিয়েছেন। উভয় প্রকার ক্ষমতা না দিয়ে যদি মানুষকে ফেরেশতার ন্যায় শুধু ভাল ও শূণ্য কর্ম করার ক্ষমতাই দান করতেন, তবে তো পয়গম্বর প্রেরণেরই আর কোন প্রয়োজন হত না। কিন্তু যেহেতু আল্লাহর ইচ্ছা হল মানুষকে সৃষ্টির-সেরা সম্প্রদায়রূপে প্রকাশ করা এবং পরীক্ষায় কৃতকার্য হলে সেরা পুরস্কার ও অনুপম নেয়ামতের অধিকারী করে তাকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দান করা, এজন্যই তাকে ভাল ও মন্দ উভয় ক্ষমতা দান করেছেন আল্লাহ্ তা'আলা বলেন-"আর আমি তাঁকে ভাল ও মন্দ উভয় পথ দেখায়ে দিয়েছি।"

সর্বপ্রকার প্রতিবন্ধকতাহীন খরস্রোতা নদীতে ভাটির দিকে নৌকা চালায়ে যাবার মধ্যে যেমন মাঝির কোন কৃতিত্ব নেই, তদ্রূপ যাঁরা শুধু ভাল কাজ করতে পারেন, মন্দ কাজ করতে সম্পূর্ণ অক্ষম, পুণ্য কর্ম সম্পাদনেও তাঁদের নিজস্ব কোন কৃতিত্ব নেই। উক্ত নদীতে সূহস প্রকার বাধা-বিঘ্ন অতিক্রম করে উজানের দিকে নৌকা চালায়ে যাওয়া যেমন মাঝির কৃতিত্ব ও বীরত্বের পরিচায়ক, তদ্রূপ যাদের মন্দ কাজ করার ক্ষমতাও আছে, মন্দের প্রবল আকর্ষণও আছে। এতদসত্ত্বেও কুপ্রবৃত্তি, শয়তানের প্ররোচনা প্রভৃতি সহস্র-প্রকারের প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে পুণ্য কর্ম করতে সক্ষম হওয়া তাদের কৃতিত্ব ও বীরত্বের পরিচায়ক।

এজন্যই মানুষ যখন সমস্ত বাধা বিঘ্ন অতিক্রম করে মন্দকে বর্জন এবং ভালকে গ্রহণ করতে পারে তখন সে ফেরেশতা অপেক্ষাও উচ্চ মর্যাদার অধিকারী হয়। আর যখন সে কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করে ভালকে বর্জন এবং মন্দকে গ্রহণ করে তখন সে পশু হতেও নিকৃষ্টতম স্তরে উপনীত হয়।

আল্লাহ তা'আলা যদি স্বীয় কুদরতে সমস্ত লোককে রাসূলের আদেশ মানতে বাধ্য করে দিতেন তবে তাদের আর মন্দ কাজ করার ক্ষমতাই থাকত না। এমতাবস্থায় মানুষের স্বাধিকার, তার পরীক্ষা, সৃষ্টসেরা হওয়া এবং সেরা পুরস্কার পাত কর ইত্যাদি সমস্ত উদ্দেশ্যই পণ্ড হয়ে যেত। এইজন্যই এরূপ করা হয় নি।

 রাসূল প্রেরণের উদ্দেশ্য 

আল্লাহ তা'আলা পরীক্ষা করার জন্য মানুষকে দুনিয়াতে প্রেরন করেছেন। যদি সে মন্দ কাজ বর্জন করে ভাল কাজ করে তবে সে পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি, সেরা পুরস্কার, অফুরন্ত নেয়ামত এবং অমর জীবন লাভ করতে সমর্থ হবে। অন্যথায় পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে আল্লাহর কোপে পতিত হবে এবং ভীষণ শাস্তি ভোগ করতে বাধ্য হবে। কিন্তু কথা হল এই যে, কি কাজ ভাল আর কি কাজ মন্দ তা চিনার উপায় কি? আর ভাল কাজগুলো কি পদ্ধতিতে করতে হবে তাইবা জানার উপায় কি?

এই প্রশ্নের সহজ উত্তর হল এই যে, মানুষের জ্ঞান আছে বলেই ত মানুষকে পরীক্ষা দিতে বাধ্য করা হয়েছে। সে তার জ্ঞান দ্বারা ভাল মন্দ চিনে নিবে। এই উত্তরটি যে সম্পূর্ণ যুক্তিযুক্ত এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। কিন্তু মানুষ যা করে বা করতে পারে, এমন কাজ অসংখ্য; আর তার জ্ঞান হল সীমাবদ্ধ ও অসম্পূর্ণ। এই ক্ষুদ্র জ্ঞান দ্বারা অসংখ্য ভাল মন্দের বিচার করা, মানুষের জন্য দুর্লঙ্ঘ পর্বতসম এক জটিল সমস্যা। ধরে নিন, জ্ঞান দ্বারা এই কথা উপলব্ধি করতে পারল যে, মানুষের প্রভু আল্লাহ তা'আলার 'ইবাদত করা যথা নামায পড়া ভাল কাজ, কিন্তু কিয়াম, কিরাআত, রুকু', সিজদা প্রভৃতি বিষয়গুলো জ্ঞান দ্বারা উপলব্ধি করা কি সম্ভবপর হত? এগুলো ত অতি সূক্ষ্ণ বিষয়। মোটামুটি বিষয় সম্বন্ধেই ত দর্শন শাস্ত্র হাজার হাজার বৎসরের চেষ্টার পরও অতি অল্প বিষয়েই নির্ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত হতে সমর্থ হয়েছে।

আল্লাহ রাহমানুর রহীম বান্দাদের প্রতি অতি দয়ালু। তাই তিনি এই অসাধ্য বা আয়াসসাধ্য কাজ বান্দাদের জ্ঞানের উপর ন্যস্ত করেন নি। বরং ভাল মন্দ চিনিয়ে দেবার জন্য এবং কর্মপদ্ধতি ও সর্বপ্রকার কৌশল হাতে কলমে শেখায়ে দেবার জন্য পয়গম্বর প্রেরণের ব্যবস্থা করেছেন। সুতরাং আল্লাহর প্রেরিত পয়গম্বর (সাঃ) হলেন মানব সমাজের আদর্শ। তিনি যা করতে বলেন এবং স্বয়ং যা করেন, তাই হল ভাল কাজ; আর যে কাজ হতে বিরত থাকেন বা করতে নিষেধ করেন, তাই হল মন্দ কাজ। এখন আর যুক্তিতর্ক নিয়ে মাথা ঘামাবার দ্বারা যে-সত্য উদ্ধার করা দুষ্কর হয়ে পড়ে, রাসূলের পবিত্র জীবন হতে তা বিনা মেহনতে এবং অনায়াসেই লাভ করতে পারা যায়।

রাসূল (সাঃ)-এর সত্য প্রচার কালে আল্লাহ তা'আলা মানব-সমাজকে তাঁর আদেশ মানতে বাধ্য করেন নি বরং সম্পূর্ণ স্বাধিকার দিয়ে রেখেছিলেন। এতে এক দিকে যেমন মানুষের পরীক্ষা করা উদ্দেশ্য ছিল, অপর দিকে তেমনই স্বীয় বান্দাদেরকে রাসূলের মারফত কর্মপদ্ধতি শিক্ষা দেবারও উদ্দেশ্য ছিল। রাসূল (সাঃ)-এর সত্য প্রচার এবং কাফিরদের বিরুদ্ধাচারণ প্রভৃতি ঘটনা প্রবাহের মধ্যে সত্যের সেবকের জন্য কর্মপদ্ধতি, প্রচার কৌশল, বিপদে ধৈর্যাবলম্বন, দৃঢ়সংকল্প থাকা, উদ্যম, অধ্যবসায় প্রভৃতি অনেক কিছু শিখার আছে।


পরিশেষেঃ 

প্রিয় পাঠক, আজকের আর্টিকেলের মাধ্যমে আমরা বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর জীবনী সিরিজ পর্বের ৯ম পর্ব শেষ করেছি। এই সিরিজের ১০ম পর্বটি পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url