মহানবী সাঃ এর জীবনী। Muhammad The Final Legacy. Ep-01
আসসালামু আলাইকুম, প্রিয় পাঠক, এখন আগের মতো বই হাতে নিয়ে টেবিলে, সোফায়, খাটে, হাটে, ঘাটে, মাঠে, বাস বা ট্রেন যাতায়াতে কিংবা হাটতে হাটতে পড়তে ভালো লাগেনা। এখন বই পড়তে ভালো লাগে মোবাইলে। তাছাড়া বই হাতে নিয়ে বহন করার চেয়ে ক্ষেত্র বিশেষে মোবাইলে পড়তে সুবিধা বেশি পাওয়া যায়। তাই আজকের আর্টিকেলের মাধ্যমে আমি আপনাদের সাথে শেয়ার করতে যাচ্ছি সম্পুর্ন বাংলা ভাষায় পর্বভিত্তিক ভাবে মুসলিম উম্মাহের সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর জীবনী সম্পর্কে। প্রিয় পাঠক, আমাদের ধারণা আপনি হয়তো মহানবী সাঃ এর জীবনী পড়েছেন তবে সেটা সংক্ষিপ্তভাবে কিন্তু আজ আমি আপনাদের কাছে যেই সিরিজ পর্বটি তুলে ধরতে যাচ্ছি সেটা হচ্ছে মহানবী সাঃ এর জন্ম এর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিটি পদক্ষেপের তথ্য সম্বলিত জীবনী। যাহা পড়লে আপনি জানতে পারবেন মহানবী সাঃ এর জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মহানবীর আদর্শ জীবন গঠনের সঠিক ধাপ সম্পর্কে। চলুন আজকের পর্ব শুরু করা যাক-
মহানবী সাঃ এর শৈশবকাল
আদি মানব হযরত আদম (আঃ)-এর নবুওয়ত প্রাপ্তির ছয় হাজার এক শত তের বছর অতীত হবার পর আজ রবী'উল আউয়ালের বার তারিখ। দ্বাদশীর অপূর্ণ চন্দ্র সারা রাত্রি স্নিগ্ধ আলো দান করে সবেমাত্র অস্তাচলে গমন করল। ক্ষীণ শুভ্র প্রভাতী আলো ক্রমসরু ও সুক্ষাগ্র স্তম্ভস্বরূপ (সুবৃহে কাযিব) আত্মপ্রকাশ করে দিনমনির আগমনের প্রাথমিক বার্তা জানিয়ে গেল। আবার পূর্ব আকাশের উদয় তোরণে প্রভাতের অগ্রদূত সূবহে-সাদিক স্বীয় রক্ত রাগে পূর্ব গগণ উদ্ভাসিত করে দিবাকরের আগমন আসন্ন বলে গোষণা করল। আকাশের অগণন তারকারাজি আজ যেন আনন্দে আত্মহারা হয়ে অপূর্ব জ্যোতিতে দিগদিগন্ত প্রদীপ্ত করে তুলেছে। মাহফিলে আঞ্জুমনের অভূতপূর্ব রওনকে যেন সারা জাহান অভিনব দৃশ্যে সুশোভিত হয়ে উঠেছে।
নিশাচরগণ ঝাঁকে ঝাঁকে মধুর ধ্বনি করতে করতে উল্লাসিত মনে শোঁ শোঁ শব্দে দ্রুত বেগে বাসাভিমুখে প্রত্যাবর্তন করতেছে। দিবাচর বিহঙ্গরা আনন্দ স্পন্দনে প্রমত্ত হয়ে প্রভাতী গেয়ে আকাশ-বাতাস মুখরিত করে তুলেছে। কাননে কাননে রঙ্গ বেরঙ্গের নয়ন জুড়ানো পুষ্পরাজি প্রস্ফুটিত হয়ে অপূর্ব শোভা ধারণ করেছে। কত মনোরম সে দৃশ্য। কত মনোমুগ্ধকর তার সৌরভ।
![]() |
| মহানবী সাঃ এর সম্পুর্ন জীবনী। Mohammad The Final Legacy. |
নদ-নদী ও গিরিনির্ঝার উচ্ছ্বসিত হয়ে কুলকুল রবে আনন্দ-গান গাইতে গাইতে সাগর পানে ছুটে চলছে। প্রভাতের প্রাণ-স্নিগ্ধকর সুশীতল বাদে-সাবা (সমীরণ) তাপিত ধরণী-বক্ষ শীতল করে শাখা-পল্লব হেলিয়ে দুলিয়ে মন্থর গতিতে চলছে। জড়-জীব, জলচর-খেচর, বন্য-পোষ্য নির্বিশেষে আজ সারা ভূলোক দ্যুলোক পুলক-স্পন্দনে জেগে উঠেছে।
আজ যেন বেহেশতের দ্বার উন্মুক্ত। জ্যোতির্ময় ফেরেশতাগণ আনন্দে আত্মহারা হয়ে কারও অভ্যর্থনার জন্য দলে দলে বের হয়ে পড়ছেন। বেহেশতী হুর গিলমান সবই বেহেশতী অর্ঘ্যপূর্ণ ডালা হাতে করুণা-পুষ্প ছড়াতে ছড়াতে দিগ্বিদিক ছড়িয়ে পড়ছেন। জ্যোতির্ময়ীদের জ্যোতিতে সারা জাহান ঝলমল করে উঠছে। স্বর্গ, মর্ত, ঊর্ধ্ব, অধঃ সর্বজগতেই আজ আনন্দের ফোয়ারা বয়ে ছুটেছে। দ্যুলোক ভূলোক পুলক শিহরণ জাগিয়া উঠেছে।
আজিকার প্রভাত এমন স্নিগ্ধ পেলব হয়ে দেখা দিল কেন? আজ কেন এত আলো, এত সৌরভ, এত শোভা? আজ সৃষ্টিময় এত আনন্দ-উল্লাস কেন? একি? এরা আবার কে? এই আনন্দ মুখর জগতে এরা কেন এত ভীত ও সম্ভ্রস্ত? এদের কেন এত আর্তনাদ? এরা আত্মরক্ষার জন্য পলায়নোদ্যত, এস্ত ব্যস্ত হয়ে এদিক ওদিক ছুটাছুটি করতেছে, কোথাও কোন মাথা গুঁজিবার স্থান পাচ্ছে না।
এরা দেখি আল্লাহর শত্রু শয়তানের দল। এরা আজীবন শিক্ক, বিদ 'আত, অনাচার অত্যাচারে নিমজ্জিত। আজ তারা যেন সর্বহারা নিঃসহায়। মনে হয় যেন কোন আসন্ন মহাপুরুষের ভয়ে আজ তাদের পাপসিংহাসন প্রকম্পিত; তাদের রাজ-প্রাসাদের গগন-স্পর্শী উচ্চ চূড়াসমূহ ভূলুণ্ঠিত চূর্ণ-বিচূর্ণ। আজ তাদের সমস্ত রাজ্যবর্গ ঠাকুর দেবতাগণ উপাস্যের গদি হতে অপসারিত অবনত মস্তকে ভূপাতিত, লাঞ্ছিত, অপমানিত।
একদিকে শয়তান ও তার চেলা-চামুণ্ডাদের দুর্দশা ও আর্তনাদ; অপর দিকে সারা মাল্লুকের আনন্দোচ্ছ্বাস। আজ কি কোন সার্বজনীন অনাগত প্রিয় অতিথির আগমন-মুহূত আসন্ন? এই মহামানব, মহাশ্রদ্ধাসম্পদ, সৃষ্টসেরা মেহমান কে? কাঁর অভ্যর্থনার জন্য এত আয়োজন? কাঁর ইস্তিকবালের জন্য এত সমারোজ? নাসূত ও মালাকৃতের সর্বত্র কেন এত আলোড়ন, এত জাগরণ?
হযরত নূহ, হযরত ইব্রাহীম, হযরত মূসা, হযরত 'ঈসা প্রমুখ নবী-রাসূল (সাঃ)-গণ যুগ যুগান্তর ধরে যে মহামানবের প্রতীক্ষায় ছিলেন, তাঁরা যে মহানবীর আগমনবার্তা প্রচার করে গিয়েছিলেন, আজ তাঁরই আগমন-মুহূর্ত আসন্ন। তাঁরই ইস্তিকালের জন্য এতসব আয়োজন। তাই আজ কোথাও ব্যথা নেই, বেদনা নেই, শোক নেই, অভাব নেই, আজ যেন সমস্ত রিক্ততার চির অবসান ঘটেছে। আকাশে-বাতাশে, জলে-স্থলে, লতায়-পাতায়, জড়-চেতনে, স্বর্গ-মর্তে সর্বত্রই আজ যেন সফলতা ও কৃতকার্যতার পরিপূর্ণতাও সার্থকতার মহাপরিতৃপ্তি ভাসিয়ে বেড়াতেছে।
এ আনন্দ মুখর ধরণীতে ১২ রবী'উল আউয়াল সোমবার সুবহে সাদিকের শুভ মুহূর্তে বেহেশতী ফুল, নব অতিথি, মানব জাতির পরম ও চরম আদর্শ, স্রষ্টার সর্বশ্রেষ্ট সৃষ্টি, সৃষ্ট জগতের মূর্ত কল্যাণ, সায়্যিদুল মুরসালীন, খাতিমুন, নবিয়্যীন, রাহমতুললিল 'আলামীন আহমদ মুজতবা মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহ 'আলায়হি ওয়াসাল্লাম মহাসমারোহে জন্মগ্রহণ করলেন।
মহানবী সাঃ এর নামকরণ
প্রিয়তম পূত্র 'আবদুল্লাহর মৃত্যুতে শোকে দুঃখে 'আবদুল মুত্তালিব অত্যন্ত মর্মাহত ছিলেন। বিধবা পুত্রবধূ আমিনার গর্ভে মৃত 'আবদুল্লাহর একটি পুত্র-সন্তান জন্মগ্রহন করেছেন সংবাদ পেয়ে যুগপৎ হর্ষ ও বিষাদে 'আবদুল মুত্তালিবের মন ভরে উঠল। পক্ষান্তরে মৃত পুত্রের স্মৃতি তাঁর মানসপটে নূতন করে জাগিয়ে তুলল এই নবাগত তরুণ মেহমান। হারাধন 'আবদুল্লাহর ঔরসজাত পৌত্রের জন্ম সংবাদ শুনে 'আবদুল মুত্তালিবের আর আনন্দের সীমা রইল না। সংবাদ পাওয়া মাত্রই তিনি আমিনার সূতিকাগৃহে উপস্থিত হয়ে প্রিয় পুত্রের চাঁদমুখ দর্শন করলেন। কি সুন্দর জ্যোর্তিময় তাঁর মুখশ্রী। তাঁর পবিত্র চেহারা দর্শন করে তিনি শোক-তাপ সব ভুলে গেলেন। তাঁর শোক সন্তপ্ত প্রাণ ঠাণ্ডা হল; নয়ন জুড়িয়ে গেল। তিনি আগ্রহের আতিশয্যে আর স্থির থাকতে পারলেন না। তৎক্ষণাৎ প্রিয়তম পুত্রকে কোলে নিয়ে পবিত্র কা'বা গৃহে প্রবেশ করলেন এবং অন্তরের অন্তস্থল দিয়ে তাঁর জন্য প্রাণ ভরে দু'আ করলেন। তৎপর শিশু পুত্রকে আমিনার কোলে ফিরিয়ে দিলেন।
সাত দিন অতীত হয়ে গেল। 'আরবের চিরাচরিত প্রথানুসারে 'আবদুল মুত্তালিব প্রিয় নাতির 'আকীকা-উৎসবের আয়োজন করলেন। আত্মীয় স্বজন ও মক্কার নেতৃস্থানীয় কুরায়শদেরকে যিয়াফৎ করলেন। ভোজ সভায় সমবেত সরদারগণ ভোজনান্তে শিশুকে দেখে যার পর নেই খুশী হলেন। তাঁরা 'আবদুল মুত্তালিবকে জিজ্ঞেস করলেন শিশুর নাম কি রাখলেন?
তিনি উত্তর করলেন: তাঁর নাম মুহাম্মদ। তাঁরা বললেন, 'মুহাম্মদ' নাম ত আমরা আর কখনও শুনি। এমন অদ্ভুত নাম রাখলেন কেন?
বৃদ্ধ বললেন: আমার এই প্রিয় নাতিটি জগতে বরেণ্য হউক, সর্বজনের নিকট প্রশংসিত হউক, এজন্যই তাঁর নাম রাখলাম 'মুহাম্মদ'।
মহানবী সাঃ এর ধাত্রীক্রোড়
সে যুগে শহরবাসী অনেক ভদ্র মহিলাই শিশুদেরকে স্তন্য প্রদান করা গৌরব-হানিকর বলে মনে করতেন। সুতরাং সম্ভ্রান্ত পরিবারে শিশু সন্তান জন্মগ্রহণ করলে তার লালন-পালন ও স্তন্য প্রদানের ভার কোন বেদুইন ধাত্রীর হাতে ন্যস্ত করা হত। কারণ, তাঁরা মনে করতেন যে, বেদুইন সমাজে এমন বহু বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান আছে যা নাগরিক সমাজে নেই। তারা বাস করে নিজেদের মুক্ত মন নিয়ে মুক্ত আকাশের তলে, মুক্ত বাতাসে, দিগন্ত বিস্তৃত মরু প্রান্তরের বালুকাময় ভূমিতে তাদের বন্ধনহীন জীবনের কোথাও কপটতা নেই, কৃত্রিমতা নেই। তারা প্রকৃতির কোলে লালিত পালিত। তাদের জীবন ওতপ্রোতভাবে প্রকৃতির সাথে জড়িত ও সংমিশ্রিত। উষা-আলোর ঝর্ণা-ধারায় প্রাতঃস্নান করা, অশ্ব ছুটিয়ে দূর-দিগন্তে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া, মরু-উদ্যানের খেজুর-কাননে তাঁবু খাটায়ে পরাও ঢালা, চাঁদনী রাতে নহর-কিনারায় ভ্রমণ করে আনন্দ উপভোগ করা, আবার কখনও বা উষ্ট্ররূপ স্থল জাহাজে আরোহণ করে মরু-মরিচিকা-সমুদ্র পাড়ি দেওয়া এবং উষ্ট্রের পৃষ্ঠাড়ালে মাথা লুকায়ে প্রচণ্ড সাইমুথ-ঝটিকার প্রকোপ হতে আত্মরক্ষা করা, এসব কিছুই হল বেদুইন-জীবনের বিশেষত্ব। তাদের জীবন আগাগোড়া প্রাকৃতিক সাঁচে গড়া। এজন্য তাদের দেহ যেমন নিখুঁত স্বাস্থ্যবান, তাদের অন্তরও তেমনি বল বীর্য, সাহস এবং স্বাধীনতা-স্পৃহায় পরিপূর্ণ।
আবার যেহেতু বৈদেশিক পর্যটকদের সাথে তাদের মিলা-মিশার সুযোগ নেই, এজন্য তাদের চির গৌরবময় মাতৃভাষা অলঙ্কারপূর্ণ প্রাঞ্জল খাঁটি 'আরবী। এইসব কিছু 'আরব-জীবনের গৌরবময় বৈশিষ্ট্য।
সুতরাং অবোধ শিশু বেদুইন সমাজে প্রাকৃতিক পারিপার্শ্বিকতার ভিতরে শৈশব-জীবন অতিবাহিত করলে কালে সে স্বাস্থ্যে, বল-বীর্যে, সাহসে এবং মাধুর্যপূর্ণ ভাষায় উচ্চ স্থান অধিকার করতে পারবে, এ আশায় নাগরিক সম্ভ্রান্ত সম্প্রদায় চির দিনই আপন শিশুদেরকে লালন পালনের জন্য বেদুইন ধাত্রীদের হাতে সোপর্দ করে আসতেছেন। কারণ এ কচি বয়সে শিশুর মনে যে-শিক্ষা ও যে-আদর্শ রেখাপাত করা যায়, তা চিরস্থায়ী হয়ে থাকে।
ভদ্র সমাজে অতি প্রাচীন কাল হতে এ প্রথা প্রচলিত হয়ে আসতেছিল। এমন কি, পরবর্তীকালে যখন উমায়্যা বংশের খলীফাদের প্রবল প্রতাপে সারা জাহান প্রকম্পিত এবং তাঁদের পরাক্রম ও প্রতিপত্তির সম্মুখে সারা দুনিয়া অবনত মস্তক, তখনও তাঁদের মধ্যে এ প্রথার কোন ব্যতিক্রম ঘটেনি। তখন উমায়্যা রাজ-পরিবারের শিশুরা বেদুইন ধাত্রী-গৃহে লালিত পালিত হতেন। কিন্তু বিশেষ কোন কারণ বশতঃ একমাত্র 'আবদুল মালিকের পুত্র ওলীদই বেদুইন ধাত্রী-গৃহে প্রেরিত না হয়ে রাজপ্রাসাদেই লালিত পালিত হয়েছিলেন। ফলে তিনি 'আরবী সাহিত্যে এত দুর্বল ও অপরিপক্ক থেকে যান যে, বিশুদ্ধ ও মার্জিতরূপে আরবী বলতেও তিনি অক্ষম হয়ে পড়েন।
বিশ্বনবী হবরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সুওয়ায়বা
এই চিত্তারিত প্রথানুযায়ী প্রতিপালা শিশুদের খোঁজে ধাত্রী ব্যবসায়ী বেদুঈন মহিলাপন বছরে দুইবার দলে দলে শহরে আগমন করত।
হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সাঃ) সর্বপ্রথম তাঁর শ্রদ্ধেয়া জননী হযরত আমিনার স্তন্য পান করেন। দুই তিন দিন পর তাঁর চাচা আবু লাহাবের সুওয়ায়বা নামী এক মাসী তাঁকে স্তন্য পান করান।
ইতঃপূর্বে সুওয়তা হযরতের চাচা হযরত হামযাকেও স্তন্য পান করিয়েছিলেন।
পাঠকগণ পূর্বেই জানতে পারছেন, যে হযরত হামযা রাসূল (সাঃ)-এর খালাত ভাই ছিলেন। সুতরাং তিনি রাসূল (সাঃ)-এর চাচা, খালাত ভাই এবং দুধ ভাই। হাদীসে আছে যে, হযরত হামযার একটি ছোট মেয়ে রাসূল (সাঃ) কে চাঙা বলে ডাকতেন, তা ছিল তার কারণ। এই সুওয়ায়বা রাসূল (সাঃ)-এর পরে হযরত আবু সালমাকেও স্তন্য পান করিয়েছিলেন। সুওয়াবার যে পুত্রটির সাথে রাসুল (সাঃ) স্তন্য পান করতেন তাঁর নাম ছিল মসরূহ। সুতরাং তাঁরাও রাসুল (সাঃ)-এর দুধ ভাই ছিলেন।
ইবনে সা'আদের বর্ণনানুযায়ী বুঝা যায় যে, সুওয়ায়বা মুসলমান হন নি। কিন্তু তিনি রাসূল (সাঃ)-এর দুধ মা হওয়ার দরুন হযরত খাদীজা তাঁকে অত্যন্ত সম্মান করতেন। হিজরতের পরে আবু লাহাব সুওয়াবাকে আযাদ করে দিয়েছি। অন্য পানজনিত মাতৃভক্তি প্রদর্শনার্থ রাসূল (সাঃ) প্রায়ই (তাঁর নিকট) বস্ত্রাদি উপটৌকন স্বরূপ প্রেরণ করতেন। খয়বর রণাঙ্গন হতে প্রত্যাবর্তনের পর রাসূল (সাঃ) জানতে পারলেন যে, সুওয়ায়বা পরলোক গমন করেছেন। তাঁর পুত্র মসৃন্ধত্ মুসলমান হয়েছিলেন কিনা, এ সম্বন্ধে কিছুই জানা নেই।
পিতৃব্য পরিবারের একটি লাঞ্ছিতা, উপেক্ষিতা, প্রপীড়িতা ক্রীতদাসী, জগতের সমস্ত নির্মম ও কঠোর দুর্ব্যবহার সহ্য করার জন্য যার জন্ম, সেই সুওয়ায়বা কয়েকদিন অথবা কয়েক বারমাত্র রাসুল (সাঃ) কে স্তন্য পান করিয়েছিলেন। এই সামান্য উপকারের বিনিময়ে আজীবন তিনি তাঁকে কত সম্মান প্রদর্শন করতেন, আর কত প্রকারে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেন। তা হল নিখিল বিশ্বের আদর্শ মহামানবের মহান শিক্ষা। উপকারীর উপকার যতই অকিঞ্চিৎকর হউক, কখনও তা ভুলতে নেই।
মহানবী সাঃ এর দুধমাতা হযরত হালীমা
হযরতের জন্মগ্রহণের কয়েক দিন পরেই ধাত্রী-ব্যবসায়ী বেদুইন মহিলাগণ প্রতিপাল্য শিশুর খোঁজে মক্কায় আগমন করল। উপযুক্ত পারিতোষিক ও বিনিময় পাওয়ার আশায় অবস্থাপন্ন ঘরের শিশুদের প্রতিই তাঁদের আধিকতর আকর্ষণ ও লক্ষ্য থাকত। এজন্য কোন ধাত্রীই বিধবা আমিনার য়্যাতীম পুত্রকে গ্রহন করতে সম্মত হল না। অপেক্ষাকৃত ধনী পরিবারের সন্তান-লাতের আশায় তারা ঘুরাফেরা করতে লাগল।
প্রত্যেকেই মনের মত এক একটি শিশু সন্তান নিয়ে দেশে ফিরল। কিন্তু হাওয়াযিন বংশীয়া ধাত্রী হালিমার ভাগ্যে এই দূর্বে য্যাতীম ব্যতীত আর অন্য কোন শিশু জুটল না। ভাগ্যবর্তী হালীমা অগত্যা শিশু মুহাম্মদ (সাঃ) কে নিয়ে স্বগৃহে ফিরলেন।
হযরত হালীমা ছিলেন হাওয়াযিম বংশের অন্তর্ভুক্ত বনু সা'আদ গোত্রের মহিলা। বনু সা'আদ গোত্র যে-যুগে অলঙ্কারপূর্ণ মাধুর্যময় বিশুদ্ধ 'আরবী ভাষার জন্য 'আরবের সর্বত্র বিখ্যাত ছিল। শহরের ভাষা নানা ধারার সংমিশ্রণে বিকৃত হয়ে পড়েছিল। সাধারণতঃ বেদুইনদের ভাষাই ছিল খাঁটি ও অলঙ্কারপূর্ণ। তন্মধ্যে বনু সা'আদের ভাষা ছিল শীর্ষস্থানীয়। 'আরবে নানা প্রকার গোমরাহী, কুসংস্কার ও কুপ্রথার ইয়ত্তা ছিল না সত্য; কিন্তু 'আরবদের নিকট কাব্য-কথা ও সুললিত ভাষার আদর ছিল অত্যাধিক। যার ভাষা যত মনোহর ভঙ্গিযুক্ত মাধুর্যময় হত সর্বসাধারণ তাঁকে তত অধিক শ্রদ্ধা করত। আল্লাহর কি অপার মহিমা, যিনি হবেন সৃষ্ট-সেরা মহামানব, যাঁর মুখনিঃসৃত মিষ্ট ভাষায় প্রাণের শত্রু পর্যন্তও স্বেচ্ছায় দাসত্ব গ্রহণ করবে, যাঁর সুললিত বাণী শুনার জন্য পৃথিবীর দিগ-দিগন্ত হতে পঙ্গপালের ন্যায় অসংখ্য নরনারী চরণতলে সমবেত হবে, জেনে; কোন অদৃশ্য শক্তির ইঙ্গিতে আজ তাঁর শৈশব জীবন অতিবাহিত করার স্থান নিরূপিত হল মাধুর্যময় ভাষা-ভাষী, মার্জিত রুচি ও উন্নতমনা সা'আদ বংশে। তাই বুঝি বিধাতার বিধান। তিনি এ অবলম্বনময় জগতে যাকে যত উন্নত করবেন, তার জীবন গঠনের উপাদানসমূহও ততই উন্নত ধরনের সংগ্রহ করে দিয়ে থাকেন।
রাসূল (সাঃ) এজন্য এমন ফাসাহতপূর্ণ (অলঙ্কারপূর্ণ) ভাষায় কথোপকথন করতেন যে, 'আরবের বিখ্যাত কবি ও সাহিত্যিকগণ তাঁর বক্তৃতা শুনে স্তম্ভিত হয়ে থাকতেন। রাসূল (সাঃ) বলেন, "আমার ভাষা তোমাদের সকলের চেয়ে অধিক ফাসাহতপূর্ণ। কেননা আমি কুরায়শ বংশীয় লোক এবং আমার ভাষা বনু সা'আদের ভাষা।
হযরত হালীমা রাসূল (সাঃ)-এর চাচাত ভাইকে অর্থাৎ তাঁর জ্যেষ্ঠ চাচা হারিসের পুত্র আবু সুফাইয়ানকেও স্তন্য পান করিয়েছিলেন। হযরত হালীমার যে পুত্রের সাথে রাসূল (সাঃ) স্তন্য পান করতেন তাঁর নাম ছিল 'আবদুল্লাহ।
হযরত হালীমার এক পুত্র ও তিন কন্যা ছিল। পুত্রের নাম 'আবদুল্লাহ এবং কন্যা তিনটির নাম আনীসা, হুযায়াফা, এবং শায়মা। শায়মা রাসূল (সাঃ) এর লালন পালন কার্যে সর্বদা মাতাকে সাহায্য করতেন। তিনি রাসূল (সাঃ)-কে বড়ই আদর যত্ন করতেন। তাদের মধ্যে 'আবদুল্লাহ এবং শায়মা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। অবশিষ্ট দুই জনের অবস্থা অজ্ঞাত। হুনায়ন যুদ্ধের পর শায়মা রাসূল (সাঃ)-এর খিদমতে আসছিলেন। তিনি তাঁর সম্মানার্থ বসার জন্য নিজের চাদর মুবারক বিছিয়ে দিয়েছিলেন।
ইবনে কাসীর লিখেছেন যে, রাসূল (সাঃ) নবুওয়াত প্রাপ্ত হওয়ার পূর্বেই হযরত হালীমা পরলোক গমন করেছেন। কিন্তু তাঁর এই বর্ণনা ঠিক নয়। 'মুখতাসর সুনান আবু দাউদ' এবং ইফাবা প্রভৃতি বহু নির্ভরশীল কিতাবে তাঁর মুসলমান হওয়ার কথা প্রমাণসহ স্পষ্টাক্ষরে লিখিত আছে। হাফিয মুগলতায়ী একখানা পুস্তিকা রচনা করে হযরত হালীমার মুসলমান হওয়ার প্রমাণ এবং বিস্তারিত বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন।
হযরত হালীমার স্বামী অর্থাৎ রাসূল (সাঃ)-এর দুধ পিতার নাম ছিল হারিস। রাসূল (সাঃ)-এর নবুওয়ত প্রাপ্তির পর তিনি মক্কায় এসে তাঁর নিকট ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি রাসূল (সাঃ)-এর খিদমতে উপস্থিত হয়ে বলেছিলেন, "আপনি এসব কি বলতেছেন।" রাসূল (সাঃ) উত্তর করলেন, "আববাজান, এমন একদিন আসবে যে দিন আমি আপনাকে দেখিয়ে দিব যে, আমি যা বলতেছি তা সত্য।" এ কথা শুনে হারিস মুসলমান হয়ে গেলেন।
হযরত হালীমা এবং তার কন্যা শায়মা রাসূল (সাঃ) কে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন। অতি যত্নসহকারে তাঁর লালন-পালন কার্য সমাধা করতে লাগলেন। যখন তাঁর বয়স দুই বছর তখন হযরত হালীমা তাঁকে তাঁর জননী হযরত আমিনার নিকট নিয়ে গেলেন। আমিনা প্রিয় পুত্রের সোনালী দেহ এবং উজ্জ্বল চেহারা মুবারক দেখে যার পর নাই মুগ্ধ হলেন। তিনি হালীমার প্রতি অতি সন্তুষ্ট হলেন এবং আল্লাহর হাজার হাজার শুযারী করলেন। এ সময়ে মক্কা নগরে সংক্রামক রোগের ভয়ানক প্রাদুর্ভাব ছিল। এজন্য আমিনা পুত্রকে আরও কিছুদিন হালীমার তত্ত্বাবধানে রেখে দেওয়া সমীচীন মনে করলেন। সুতরাং হালীমা আমিনার আদেশে পুনরায় তাঁকে নিয়ে স্বগৃহে ফিরলেন।
হযরত দুই বছর বয়স পর্যন্ত হালীমার স্তন্য পান করছিলেন। তৎপর জননীর দর্শন লাভ করে পুনরায় হালীমার সাথে ফিরে আসলেন। আবার তিনি প্রকৃতির কোলে লালিত-পালিত হতে লাগলেন। শায়মা, 'আবদুল্লাহ ইত্যাদি ভ্রাতা ভগ্নিগণ তাঁকে পুনরায় পেয়ে অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। হযরতের চরিত্র-মাধুর্যে তাঁরা সকলেই তাঁর প্রতি অত্যন্ত অনুরক্ত হয়ে পড়লেন। উপরে সুনীল স্বচ্ছ আকাশ, নিম্নে বিস্তৃত যুক্ত প্রান্তর, অদূরে স্তব্ধ মৌন নগ্ন পর্বতমালা, মাঝে মাঝে উপত্যকা ও অধিক্যতার বিচিত্র সমাবেশ। প্রকৃতির এই বিচিত্র লীলাভূমিতে ভাইবোনদের সাথে আমোদ প্রমোদের ভিতর দিয়ে হযরতের শৈশব-জীবন অতিবাহিত হতে লাগল। তিনি ক্রমশঃ বর্ধিত হতে লাগলেন। এভাবে হযরত হালীমার বাড়ীতে তাঁর ছয়টি বছর কেটে গেল। তৎপর তিনি আবার মাতৃ সদনে প্রেরিত হলেন।
মহানবী সাঃ এর বক্ষবিদারণ এর ঘটনা
রাসূল (সাঃ) যখন হযরত হালীমার গৃহে অবস্থান করতেছিলেন তখন তাঁর জীবনে একটি অলৌকিক ঘটনা ঘটে। এ ঘটনা 'শত্রুস্ সদর' বা 'বক্ষবিদারণ' নামে পরিচিত। এ ঘটনা হতে তাঁর নবুওয়ত জীবনের প্রত্যক্ষ নির্দশন বাইরে আত্মপ্রকাশ করতে আরম্ভ করে।
হযরত শাহ হওয়ালিউল্লাহ্ মুহাদ্দিস দেহলবী রহমতুল্লাহি 'আলায়হ্ বলেন যে, সৃষ্টিগতভাবে প্রত্যেক মানুষের মধ্যে মালাকৃতী ও শয়তানী নামক দুটি দৈহিক শক্তি বিদ্যমান আছে। প্রথমটি দ্বারা মানুষ ফেরেশতাদের স্বভাব গ্রহণ করে এবং অপরটি দ্বারা শয়তানী স্বভাব গ্রহণ করে। যেহেতু রাসূল (সাঃ)-এর সংশ্রব বে জগতের সাথে এবং সর্বদা তাঁর সংবাদ আদান-প্রদান এবং কথোপকথন হবে, ফিরেশতাদের সাথে, এজন্য তাঁর মালাকৃতি শক্তি ক্ষমতাশালী হওয়া আবশ্যক। পক্ষান্তরে শয়তান যে তাঁকে কোন প্রকার কুমন্ত্রণা দিতে পারবে না, তাও প্রমাণিত, যেমন রাসূল (সাঃ) শয়তান সম্বন্ধে স্বয়ং বলেছেন "আমি তার কুমন্ত্রণা হতে রক্ষিত" অথবা "সে আমার আনুগত্য স্বীকার করেছে।।" সুতরাং তাঁর পবিত্র শরীরে শয়তানী শক্তি বিদ্যমান থাকার কোন আবশ্যকতা নেই। এ শক্তিটি তা হতে বিদূরিত হওয়াই বাঞ্ছনীয়। এ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য বক্ষবিদারণের অলৌকিক ঘটনা সংঘটিত হয়।
ঘটনাটি এইঃ একদিন রাসূল (সাঃ) দুধ ভাইদের সাথে মেষ-চারণভূমিতে গেলেন। তথা হতে তাঁর এক দুধ ভাই দৌড়ায়ে বাড়ী যেয়ে বলতে লাগলেন, "সাদা পোশাক পরিহিত দুই জন লোক এসে আমার কুরায়শী ভাইকে শোয়ায়ে তাঁর পেট বিদীর্ণ করে ফেলেছেন।" হযরত হালীমা বলেন, "এই সংবাদ শুনামাত্রই আমি এবং তাঁর পিতা অর্থাৎ আমার স্বামী হারিস দৌড়ায়ে তাঁর নিকটে গেলাম। আমরা যেয়ে দেখতে পেলাম, তিনি দাঁড়িয়ে আছেন; তাঁর সারাদেহ বিবর্ণ। অগন তাঁর পিতা (হারিস) তাকে দুই হাতে জড়ায়ে ধরে বললেন, "প্রিয় বৎস, ব্যাপার কি?” তখন তিনি বললেনঃ আমার নিকট সাদা পোশাক পরিহিত দুই ব্যক্তি এসে আমাকে চিৎ করে মাটিতে শোয়ালেন। তৎপর আমার পেট বিদীর্ণ করে পেটের ভিতর হতে কি একটি বস্তু ফেলে দিলেন। তৎপর পুনরায় আমার পেট যেমন ছিল তেমনই করে দিলেন।
কোন কোন রিওয়াতে আছে, ফিরেশতাদ্বয় একখণ্ড কাল জমাট রক্ত ফেলে দিলেন। এটাই শয়তানী স্বভাব গ্রহণ করার এবং সমস্ত পাপের মূল উৎস?।
সামান্য পরিবর্তন বা হ্রাস-বৃদ্ধিসহ এ রিওয়াতটি বহু সূত্রে বর্ণিত আছে। জড়বাদী, ধর্মদ্রোহী ইসলামের শত্রু ইউরোপীয় লেখকগণ Epilepsy অর্থাৎ মৃগী রোগ বলে এই ঘটনাকে বিকৃত করার চেষ্টা করেছেন। যারা আধ্যাত্মিক জগতের খোঁজ জানে না, যাদের জ্ঞানের দৌড় বস্তুতান্ত্রিক জগতেই সীমাবদ্ধ, জড় পূজার কলঙ্ক-কলুষে যাদের অন্তর ও মস্তিষ্ক কলুষিত তাদের চক্ষে এসমস্ত আধ্যাত্মিক ব্যাপার এইভাবে প্রতিভাত হওয়াই স্বাভাবিক। কথায় বলে। যে বেঙ কূপে বাস করে সমুদ্র সম্বন্ধে তার কি জ্ঞান থাকবে। যারা নিজেদের রাসূল হযরত 'ঈসা (আঃ)-এর অস্তিত্ব পর্যন্ত অস্বীকার করতে পারছে তারা যে হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সাঃ)-এর একটি মু'জিযাকে অস্বীকার করবে এতে বিস্মিত হওয়ার কি আছে?
পরিশেষেঃ
প্রিয় পাঠক, আজকের আর্টিকেলের মাধ্যমে আমরা বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সঃ এর জীবনী সিরিজ পর্বের ১ম পর্ব শেষ করেছি। এই সিরিজের ২য় পর্বটি পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
