মহানবী সাঃ এর জীবনী । Mohammad: The Final Legacy. Ep-07
আসসালামু আলাইকুম, প্রিয় পাঠক আজকের আর্টিকেল এর মাধ্যমে আমি আপনাদের সাথে শেয়ার করবো মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর সম্পুর্ন জীবনী বাংলা সিরিজ আর্টিকেল এর ৭ম পর্ব সম্পর্কে। আপনি যদি 'মহানবী সাঃ এর সম্পুর্ন জীবনী' এই সিরিজ আর্টিকেলে নতুন হয়ে থাকেন এবং ষষ্ঠ পর্বটি পড়তে চান তাহলে এখানে ক্লিক করে আগের পর্বটি পড়ে নিতে পারেন। চলুন আজকের পর্ব শুরু করা যাক-
সর্বপ্রথম অবতীর্ণ আয়াতগুলোর তাৎপর্য
যুগ যুগান্তর ধরে যে মহাবাণীর জন্য সারা দুনিয়া উৎকণ্ঠিত চিত্তে প্রতীক্ষা করতেছিল, হযরত ইব্রাহীম (আঃ) তাঁর আওলাদকে যে পবিত্র বাণী পড়ে শুনাবার জন্য এবং যে কালামের অন্তর্নিহিত ইলম ও হিকমত শিখাবার জন্য তাঁর বংশে একজন পয়গম্বর প্রেরণের দু'আ করেছিলেন, আজ সেই 'ইলমের উৎস ও হিকমতের আধার পবিত্র বাণী অবতীর্ণ হল। কত মধুর সে বাণী। কত পবিত্র, কত সুন্দর সে কালাম।
সে পবিত্র বাণীর আরম্ভই হলঃ যে পয়গম্বর (সাঃ) আপনি স্বীয় প্রভুর নাম নিয়ে কুরআন পাঠ করুন।" পবিত্র কুরআন যাবতীয় জ্ঞানের আধার। কুরআন পাঠ করাই সুষ্ঠু জ্ঞান লাভ করার একমাত্র সরল ও সহজ উপায়। মানুষ জ্ঞান দ্বারা ভাল মন্দকে চিনতে পারে, মঙ্গলামঙ্গলের বিচার করে উন্নতির পথ বেছে নিতে পারে। জ্ঞান দ্বারাই মানুষ ঐহিক ও পারত্রিক সমস্ত সুখ শান্তির বিধান করতে পারে। সুতরাং জ্ঞান সাধনা হল আল্লাহর সেরা দান ও অনুপম নেয়ামত। এ জ্ঞান প্রসঙ্গ নিয়েই অবতীর্ণ হল সর্বপ্রথম ওহী, এই আলোচনা নিয়েই সূচিত হল বিশ্বনবীর পয়গম্বরজীবন, আর ইসলামের নব জয়যাত্রা। পাঠক, একবার চিন্তা করে দেখুন, ইসলামে জ্ঞানের মর্যাদা কত উচ্চ।
![]() |
| আমাদের প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ সঃ এর জীবনী |
যে মহাসত্য প্রচার করার জন্য আল্লাহ তা'আলা আপন হাবীব (সাঃ) কে প্রেরণ করলেন, যে মহান উদ্দেশ্যে পবিত্র কুরআন অবতীর্ণ হল এবং যে মহাসত্য বিস্তারের জন্য পবিত্র ইসলাম ধর্মের প্রবর্তন হল তা এই প্রথম অবতীর্ণ আয়াত কয়টিতেই সংক্ষিপ্ত সার হিসাবে বর্ণিত হয়েছে। এ আয়াত কয়টিতে আছে-
১. প্রত্যেক কাজে আল্লাহর উপর ভরসা ও তাঁর প্রতি আত্মসমর্পণ করা।
২. সত্য প্রচারে আল্লাহর সহায় হওয়া।
৩. স্রষ্টার পরিচয়।
৪. মানুষের সৃষ্টি রহস্য।
৫. কুর'আন পাঠ ও সত্য প্রচার মানব জীবনের উদ্দেশ্য ও কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত হওয়া।
৬. জ্ঞানার্জন।
৬.১। জ্ঞানরূপ অমূল্য রত্ন লাভ করার জন্যই আল্লাহ্ তা'আলা তাঁর প্রিয় হাবীবকে নির্দেশ দিলেন কুরআন পাঠ করতে। জ্ঞান বলেই মানুষ উচ্চ মর্যাদার অধিকারী হয়ে থাকে। আবার যখনই কেউ উচ্চ মর্যাদা লাভ করতে পারে তখনই তার অন্তর্নিহিত বহু শত্রু মাথা উঁচু করে দাঁড়ায় এবং তাঁকে বিপর্যস্ত করার জন্য তার অন্তর হতে নিষ্ঠা ও লিল্লাহিয়ত দূর করে সুখ্যাতি-লালসা, প্রতিপত্তি-প্রিয়তা এবং অহমিকা প্রভৃতি কুপ্রবৃত্তি জন্ম দেয়। ফলে সে এই আয়াসসাধ্য সাধনার সুফল ও বরকত হতে বঞ্চিত থাকতে বাধ্য হয়। কিন্তু মানুষ যখন সর্বশক্তিমান আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করে, অহমিকা বর্জন করে আল্লাহর উপর নির্ভর করে এবং সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পণ করে, তখন তিনি তাকে সকল আপদ হতে রক্ষা করে কৃত কর্মের বরকত ও সুফল ভোগ করার সুব্যবস্থা করে দেন। মানুষের মেহনত যেন বিফলে না যায় তজ্জন্য আল্লাহ তা'আলা সর্বপ্রথম অবতীর্ণ আয়াতেই রাসূল (সাঃ) কে নির্দেশ দিলেন যে, কুরআন পাঠরূপ মহৎ কাজ আল্লাহর নাম স্মরণ করে আরম্ভ করুন। এজন্যই কুরআন পাঠ আরম্ভকালে আন্তরিভাবে আল্লাহর উপর ভরসা করা এবং তাঁর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করা ওয়াজিব, আর মৌখিকভাবে 'বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম' পড়া সুন্নত। প্রত্যেক মহৎ কাজই আরম্ভকালে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম পড়ে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করা উচিত। অন্যথায় সেই কর্ম অসম্পূর্ণ থেকে যাবে অথবা এর সুফল ও বরকত হতে বঞ্চিত থাকতে হবে।
৬.২। "আপনার 'রব'-এর নাম নিয়ে।" 'রব' আল্লাহর একটি গুণবাচক নাম। যিনি স্বীয় তত্ত্বাবধানে ও রক্ষণাবেক্ষনে লালনপালন করে যথাযোগ্য পূর্ণত্বে পৌছায়ে দেন, তাঁকেই বলা হয় রব। এস্থলে 'আপনার রণ' বলে এই কথার প্রতি ইঙ্গিত। করা হয়েছে যে, আল্লাহ্ তা'আলা রাসূল (সাঃ) -এর পূর্ণ তত্ত্বাবধান ও রক্ষণাবেক্ষণ করবেন এসং সবুওয়াতের সর্বাসার চরম সোপানে পৌঁছায়ে দিবেন। যাঁর রক্ষণাবেক্ষণ তত্ত্বাবধানের ভার স্বয়ং আল্লাহ্ তা'আলা নিজ হাতে গ্রহণ করলেন কোন প্রতিদ্বন্দী শক্তিই, যে তাঁকে প্রতিহত করতে সক্ষম হবে না, একথা নিঃসন্দেহ। রাসূল (সাঃ) যেন সমস্ত শত্রুকে উপেক্ষা করে নিঃসঙ্কোচে সত্য প্রচার করতে পারেন, তজ্জন্য নবুওয়তের সূচনাতেই আল্লাহ্ তা'আলা তাঁকে আভাস দিয়ে দিলেন। এ কারণেই তিনি কখনও কোন কাজে সংশয়াপন্ন হন নি এবং কোন দিনই কো প্রতিদ্বন্দ্বী ক্ষমতা তাঁকে তাঁর সংকল্প হতে বিরত রাখতে সক্ষম হয় নি।
৬.৩। 'রব'-এর একটি বিশেষণ আনা হয়েছে "যিনি সব কিছু সৃষ্টি করেছেন।" যেহেতু আল্লাহ্ প্রদত্ত নেয়ামতসমূহের মধ্যে সৃষ্টিকরারূপ নেয়ামতই সর্বপ্রথম প্রকাশ পেয়েছে। এজন্য প্রথমেই এ বিশেষণের উল্লেখ করা হয়েছে। তৎসঙ্গে এ বিশেষণের উল্লেখ দ্বারা এটাও ঘোষণা করা হয়েছে যে, আল্লাহই বিশ্বনিখিলের একমাত্র স্রষ্টা। এতে বহু ভ্রান্ত মতবাদের খণ্ডন হয়ে যেতেছে। এ বিশ্বের কোন স্রষ্টা নেই; এটা স্বয়ং সৃষ্ট, আত্মা ও পরমাণু আল্লাহর ন্যায় অনন্ত ও অবিনশ্বর, একাধিক দেবতা কর্তৃক এ বিশ্ব রচিত ও নিয়ন্ত্রিত, কালচক্রের বিবর্তনই এর রক্ষক, কপিল মুণি কৃত দর্শনোক্ত পুরুষ ও প্রকৃতিই সৃষ্টির মৌলিক উপাদান ইত্যাদি বহু কুফর ও শিরক মতবাদ খণ্ডন করে স্পষ্টাক্ষরে ঘোষণা করা হয়েছে যে, একমাত্র আল্লাহ তা'আলাই সবকিছুর স্রষ্টা ও নিয়ামক। সুতরাং যিনি সব কিছুর খালিক ও মালিক, যিনি সর্বনিয়ন্তা পৃষ্টা, তাঁর মা'রিফত বা পরিচয় লাভ করা, তাঁর প্রতি ভরসা করা, তাঁর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করা এবং তাঁর প্রতি সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ করা সর্বপ্রথম ও সর্বপ্রধান কর্তব্য।
৬.৪। ব্যাপক সৃষ্টির কথা বর্ণনা করার পর বিশেষভাবে মানুষের সৃষ্টি কৌশল বর্ণনা করতেছেন: "যিনি মানুষকে জমাট রক্তপিণ্ড হতে সৃষ্টি করেছেন।" এতে প্রতিপন্ন হচ্ছে যে, মানুষ সৃষ্টসেরা জাতি। অন্যান্য সৃষ্ট পদার্থের তুলনায় মানুষের প্রতি আল্লাহর দান ও অনুগ্রহ অনেক বেশী। কারণ, আল্লাহ তা'আল্লা তাকে অতি ঘৃণ্য নির্জীব রক্তপিও হতে অতি উন্নত ধরনের আকৃতি ও প্রকৃতি বিশিষ্ট প্রাণীতে পরিণত করে গুণে, জ্ঞানে ও মর্যাদায় সৃষ্টসেরা বানিয়েছেন। এতে একদিকে যেমন আল্লাহর অসীম কুদরত প্রকাশ পেয়েছে; অপর দিকে তেমনই মানুষের প্রতি এ মহাদানের কৃতজ্ঞতাস্বরূপ আল্লাহর অনুগত ও আজ্ঞাবহ থাকা অপরিহার্য কর্তব্য বলে প্রতিপন্ন হচ্ছে।
- আল্লাহ্ তা'আলা এক এক জাতীয় বস্তুকে এক এক নিয়মে সৃষ্টি করে থাকেন। মানুষকে তিনি ক্রমবিকাশ পদ্ধতিতে সৃষ্টি করেছেন। মানুষকে তিনি যথাক্রমে কয়েকটি স্তর অতিক্রম করার পর বর্তমান আকারে পরিণত করেছেন।
- মানুষ সর্বপ্রথম মাটি, পানি ইত্যাদি হতে উৎপন্ন খাদ্য আকারে পিতা-মাতার দেহে প্রবিষ্ট হয়।
- ঐ খাদ্য পিতা মাতার রক্তমাংসে পরিণত হওয়ার পর বীর্যের রূপ ধারণ করে।
- বীর্য মাতৃগর্ভে নির্দিষ্টকাল পর্যন্ত অবস্থান করার পর রক্তপিণ্ডে পরিণত হয়।
- কিছুদিন পরে এই জমাট রক্ত হাড়বিশিষ্ট মাংসপিণ্ডে পরিণত হয়।
- তৎপর উক্ত মাংসপিণ্ডে আত্মার সঞ্চার হয় এবং জীবন্ত মানব-রূপ ধারণ করে। রক্তপিণ্ডরূপ মধ্যবর্তী অবস্থা, তার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী অবস্থাসমূহকে স্মরণ-পথে তুলে ধরে। এজন্যই বিশেষভাবে এ একটি অবস্থার উল্লেখ করা হয়েছে।
৬.৫। কুর'আন পাঠ করা উদ্দেশ্য নয়, শুধু আল্লাহর নাম স্মরণ করাই উদ্দেশ্য, এরূপ সন্দেহ যেন না হয়, তজ্জন্য পুনরায় বলতেছেনঃ "আপনি কুর'আন পাঠ করুন।" সুতরাং এই পদের পুনরোক্তিতে পরিষ্কারভাবে সাব্যস্ত হয়ে গেল যে, কুর'আন পাঠ করাও উদ্দেশ্যের অন্তর্ভুক্ত। কারণ, তা দ্বারাই ধর্মের প্রচার হয়। এজন্যই অর্থ না বুঝে শুধু কুরআনের শব্দগুলো পাঠ করাতেও অধিক সওয়াব আছে। এ কারণেই কারী ও হাফিযদের এত বড় ফযীলতের কথা হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। ধর্ম পালন করা যেমন কর্তব্য তদ্রূপ তা প্রচার করাও কর্তব্য। বিশেষরূপে পয়গম্বরগণ প্রেরিতই হন প্রচারের জন্য। এতে হযরতের নবুওয়ত এবং ধর্ম প্রচারের জন্য আদিষ্ট হওয়াও বুঝা যাচ্ছে।
৬.৬। অবশেষে বলা হল-জ্ঞানের কথা। মানুষের জ্ঞান কোথা হতে আসল? আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ "আর আপনার প্রভু অতিশয় উদার (যা ইচ্ছা দান করেন, যারা লেখা-পড়া জানে তাদেরকে কলমের সাহায্যে জ্ঞান দান করেন। (আর লেখা-পড়া জানুক বা না জানুক সাধারণভাবে প্রত্যেক) মানুষকেই ঐ সমস্ত জিনিসের জ্ঞান দান করেন যা সে জানে না।"
জ্ঞান দুই প্রকার: লেখনীবন্ধ অর্থাৎ কোন না কোন উপকরণ সাপেক্ষ এবং লেখনী বহির্ভূত অর্থাৎ আল্লাহর অনুগ্রহ লব্ধ, যা লাভ করতে কোন উপকরণ বা বাহনের প্রয়োজন হয় না। এ উভয় প্রকার জ্ঞান আল্লাহর দান। জ্ঞান ভাণ্ডারের শলাকা আল্লাহর হাতে, তিনি যাকে যে পরিমাণ ইচ্ছা, দান করেন।
কুর'আন ও দর্শন: উপরিউক্ত আয়াতে রাসূল (সাঃ) কে প্রবোধ দেয়া হয়েছে যে, আপনি লেখতে পড়তে জানেন না বলে বিচলিত হবার কোন কারণ নেই। আমি আপনাকে এমন অগাধ জ্ঞান দান করব যা মানুষেরা জানে না; অর্থাৎ দার্শনিক যুক্তিতর্ক দ্বারা মানুষ সে জ্ঞান লাভ করতে অক্ষম।
এই কারণেই দর্শনশাস্ত্রের যতই উন্নতি হচ্ছে কুরআনের বর্ণিত বিষয়-বস্তুগুলো ততই অধিকতর স্পষ্টরূপে বোধগম্য হচ্ছে। এতে একথাও প্রতীয়মান হচ্ছে যে, সভ্যতা ও প্রামাণিকতার জন্য কুরআন পৃথিবীতে প্রচলিত অপর কোন দর্শনের মুখাপেক্ষী নয়। অধিকন্ত দর্শনই এ বিষয়ে কুরআনের মুখাপেক্ষী। অতীত যুগের অভিজ্ঞতাই এর জ্বলন্ত প্রমাণ। সর্বদাই দর্শনে পরিবর্তন পরিবর্ধন এবং রদবদল হয়ে আসতেছে। কিন্তু কোন দিনই দর্শন এমন কোন সত্যের সন্ধান দিতে সক্ষম হয় নি, যা কুর'আনের বিপরীত। যাঁরা সত্যতা প্রমাণের জন্য কুর'আনকে দর্শনের সাথে তুলনা করার চেষ্টা করেন, আমার মতে তাঁরা ভুল করেন। অবশ্য এ কথা সত্য যে কুরআনের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হলে দর্শনের সিদ্ধান্তকে সত্য বলে মেনে নেয়া যেতে পারে।
দর্শনের মাধ্যমে যদিও বা কোন নির্ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়, তথাপি তা সহজসাধ্য নয়, বরং ভুল-ভ্রান্তির কণ্টকে আবৃত দুর্গম দীর্ঘপথ অতিক্রম করার পর এবং অসংখ্য মনীষীর যুগ যুগান্তের অক্লান্ত অধ্যবসায় ও সাধনার পর। এতদসত্ত্বেও তা সংশয়মুক্ত নয়। কারণ দর্শনের মতে আজ যা ধ্রুব সত্য, কাল হয়ত তাই হয়ে যাবে সম্পূর্ণ মিথ্যা অথবা আজ যা মিথ্যা দুদিন পর তাই হয়ে যাবে নির্ভুল সত্য। সারা বিশ্বের সৃষ্টি-তথা, আকাশের অস্তিত্ব ও সংখ্যা, পৃথিবী স্থির, না গতিশীল, গ্রহসমূহের মধ্যে পরস্পর আকর্ষন আছে, না নাই, ইত্যাদি বিষয়ে প্লাটু ও সক্রিটিসের যুগ হতে আজ পর্যন্ত এ দীর্ঘ বয়দ্ধ প্রবীন দর্শন শাস্ত্র যে কতবার কত সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে, কতবার কত মত পরিবর্তন করেছে, কত উলট পালট ও রদ-বদলের পর বর্তমান সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে, তা দার্শনিকদের অবিদিত নেই। বর্তমান সিদ্ধান্ত যে নির্ভুল: এতে যে আর কোন পরিবর্তন ঘটবে না তাঁদের নিকট এই কথারও কোন প্রমাণ নেই। পক্ষান্তরে পবিত্র কুরআন প্রথম দিন যে সিদ্ধান্ত নিয়ে এই ধরাধামে অবতীর্ণ হল; অদ্যাবধি সে সেই সিদ্ধান্তের উপরই আছে, আর কিয়ামত পর্যন্তও এর উপরই দৃঢ়পদ থাকবে। নিরপেক্ষভাবে স্থির চিত্তে ন্যায় ও সততার ভিতর দিয়ে চিন্তা করলে প্রত্যেকেই এই কথা স্বীকার করতে বাধ্য হবেন যে, কুরআনের সিদ্ধান্তগুলো অটল, সত্য ও নির্ভুল এবং অতি সরল ও সহজসাধ্য।
এমতাবস্থায় পবিত্র কুরআন ঘরে রেখে দর্শনের সাহয্যে বিদ্যান্বেষণ করা, আর বনু ইসরাঈলের বেহেশতী খাদ্য মান্না-সালওয়া পরিত্যাগ করে তরি তরকারি, ডাল, পেয়াজ, রসুন প্রভৃতি কৃষিজাত খাদ্যান্বেষণ করা একই কথা। সুতরাং হযরত মুসা বনু ইসরাঈলকে যা বলেছিলেন, এছলেও তাই বলা যাবে, "তোমরা কি উত্তমের বিনিময়ে অধমকে গ্রহণ করতে চাও।" হাজার হাজার বৎসরের গবেষণার পর দর্শন বলতেছে
১. মানবচক্ষুর অন্তরালে এমন এক চৈতন্যময় শক্তি বিদ্যমান আছে যা কর্তৃক এই বিশ্বজগৎ সৃজিত ও নিয়ন্ত্রিত।
২. প্রোটোপ্লাজম নামক এক প্রকার সূক্ষ্ণপদার্থ হতে মানুষ সৃজিত হয়েছে।
৩. জ্ঞান দুই প্রকার: (ক) কারন প্রসূত জ্ঞান এবং (খ) স্বতঃসিদ্ধ জ্ঞান বা সপ্তসমুদ্র মন্থনের পর দর্শন আজ যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে। পবিত্র কুরআন তো চৌদ্দশত বৎসর পূর্বে যে মূহূর্তে অবতীর্ণ হয়েছিল সেই মুহূর্তেই অতি সরল ও সহজ ভাষায় বজ্রকণ্ঠে তা ঘোষণা করেছিল-
- নিখিল বিশ্বের স্রষ্টা একমাত্র আল্লাহ্।
- আল্লাহ্ তা'আলা এক বিন্দু রক্ত কনিকা হতে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন।
- জ্ঞান দুই প্রকার-লেখনীবন্ধ অর্থাৎ কারণপ্রসূত বা উপকরণ সাপেক্ষ এবং আল্লাহর অনুগ্রহলব্ধ বা স্বতঃসিদ্ধ।
মানুষের এই উভয়বিধ জ্ঞান একমাত্র আল্লাহরই দান। এ মহাসত্য নিয়েই অবতীর্ণ হল সর্বপ্রথম ওহী। এ মহাসত্য দিয়েই আল্লাহ তা'আলা পয়গম্বীতে দীক্ষিত করলেন হযরত মুহাম্মদ মুস্তফাকে (সাঃ)। এটা নিয়েই আত্মপ্রকাশ করল পবিত্র ইসলাম। এই সরল ও সংজ সত্য প্রচার করার জন্যই আদিষ্ট হলেন আল্লাহর হাবীব প্রিয় রাসূল মুহাম্মদ (সাঃ)।
বিশ্বমানব যখন তিলে তিলে উপলব্ধি করবে যে, একমাত্র আল্লাহই এই নিখিল বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা। তিনিই একমাত্র রক্ষাকারী ও ধ্বংসকারী। আমাদের জীবন-মরণ তাঁরই হাতে। তিনি ছাড়া আমাদের আর কোন সহায়ও নেই, শরণ্যও নেই।
তিনিই হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) কে প্রেরণ করেছেন তাঁর নির্দেশ আমাদেরকে পৌঁছাবার জন্য, আমাদেরকে সরল পথ দেখাবার জন্য, সকল আপদ হতে বাঁচায়ে আমাদেরকে তাঁর সন্নিধানে চির শান্তিনিকেতনে পৌছাবার জন্য, তখন স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়েই মানবের অন্তর ও মুখ হতে ফুটে বের হবে:
"আল্লাহ ছাড়া আর কেউ "ইবাদতের যোগ্য নেই, আর মুহাম্মদ মুস্তফা (সাঃ) তাঁর প্রেরিত মহাপুরুষ।"
মানুষ যখন মনে প্রাণে উপলব্ধি করবে যে, আল্লাহ তা'আলা অতি তুচ্ছ ও ঘৃণার্হ পদার্থ হতে এবং অতি নিঃসহায় অবস্থা হতে তাকে জ্ঞান বিবেকসম্পন্ন সৃষ্টসেরা মানবে পরিণত করেছেন, তখন আল্লাহর অনন্ত করুণা ও কুদরতের কথা স্মরণ করে কৃতজ্ঞায় তার মস্তক অবনত হয়ে পড়বে এবং তার অন্তর মুখ, ভিতরে বাইরে এবং সমস্ত অঙ্গ-প্রতঙ্গ হতে ধ্বনিত হয়ে উঠবে-
"হে আমাদের প্রভু, আপনি যা অবতীর্ণ করেছেন তার প্রতি আমরা ঈমান আনয়ন করলাম এবং আপনার প্রেরিত পয়গম্বরের আনুগত্য স্বীকার করলাম আপনি পূর্ণ ঈমানদারগণের দফতরে আমাদের নাম লিখে নিন।"
আবার যখন সে বুঝতে পারবে যে, আল্লাহই সকল জ্ঞানের উৎস এবং জ্ঞানের আলো ছাড়া সৃষ্টি-লীলার কোন রহস্যই হৃদয়ঙ্গম করতে পারা যায় না তখন সে কটিদেশ বেঁধে জ্ঞান সাধনার অভিযানে বের হয়ে পড়বে এবং উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠে বলে উঠবে- "হে আমার প্রভু, আপনি আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করে দিন।"
পাঠক, একটু চিন্তা করে দেখুন-প্রথম অবতীর্ণ এই ক্ষুদ্র আয়াত কয়টি কত সুন্দর ও সহজ, অথচ কত নিগূঢ় তাৎপর্যপূর্ণ কুর'আনের এই ক্ষুদ্র অংশটুকু যেন সমস্ত জ্ঞানের সারাংশ। বাস্তবিক সর্বপ্রথম অবতীর্ণ হবার উপযুক্ত বাণীই বটে।
পরিশেষেঃ
প্রিয় পাঠক, আজকের আর্টিকেলের মাধ্যমে আমরা বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর জীবনী সিরিজ পর্বের ৭ম পর্ব শেষ করেছি। এই সিরিজের ৮ম পর্বটি পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন।
