মহানবী সাঃ এর জীবনী | Mohammad: The Final Legacy. Ep-06
আসসালামু আলাইকুম, প্রিয় পাঠক আজকের আর্টিকেল এর মাধ্যমে আমি আপনাদের সাথে শেয়ার করবো মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর সম্পুর্ন জীবনী বাংলা সিরিজ আর্টিকেল এর ষষ্ঠ পর্ব সম্পর্কে। আপনি যদি 'মহানবী সাঃ এর সম্পুর্ন জীবনী' এই সিরিজ আর্টিকেলে নতুন হয়ে থাকেন এবং ৫ম পর্বটি পড়তে চান তাহলে এখানে ক্লিক করে আগের পর্বটি পড়ে নিতে পারেন। চলুন আজকের পর্ব শুরু করা যাক-
মহানবী সাঃ এর নবুওয়ত লাভ
নবুওয়ত: ওরাকা, যায়দ এবং 'উসমান ইবন হুওয়ায়রিস প্রমুখ একত্ববাদিগণ পৌত্তলিকতার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে সত্য ধর্মের অন্বেষণে ব্যাপৃত ছিলেন। বহু প্রচেষ্টার পর বিফল মনোরথ হয়ে ওরাকা ও 'উসমান হয়ত মনে করলেন 'নাই মামার চেয়ে কানা মামাই ভাল।' তাই তাঁরা খৃষ্টধর্ম গ্রহণ করলেন। সত্য ধর্মের খোজ না পেয়ে মর্মাহত অন্তরে যায়দ বলতেন, 'হে প্রড় "কিভাবে তোমার 'ইবাদত-বন্দেগী করতে হয়, অবগত হতে পারলে ঠিক সেভাবেই আমি তোমার ইবাদত করতাম।" এ মর্মন্তদ বেদনা নিয়েই তিনি ইহলোক পরিত্যাগ করলেন।
রাসূল (সাঃ) সাংসারিক ঝঞ্ঝাটে আবদ্ধ ছিলেন। একদিকে বিরাট ব্যবসা বাণিজ্য, পণ্য-দ্রব্যের আমদানী রফতানী, দেশ-বিদেশে যাতায়াত, অপর দিকে ছেলে-মেয়ে এবং পরিবার পরিজনের তত্ত্বাবধান ইত্যাদি নানা ঝঞ্ঝাটের ভিতর দিয়ে জীবন যাত্রা চালায়ে যেতেছেন। তা সত্ত্বেও যে উদ্দেশ্যে তাঁর সৃষ্টি, সে অজ্ঞাত উদ্দেশ্যের একটা মহান ভাব তার অন্তরে সর্বোচ্চস্থান অধিকার করে বসল। ধন-দৌলত স্ত্রী-পুত্র সবকিছু তাঁর নিকট অকিঞ্চিঃকর মনে হতে লাগল। কিন্তু কি মহান উদ্দেশ্যে যে আল্লাহ তা'আলা তাঁকে সৃষ্টি করেছেন, তা তিনি এখনও জানতে পারেন নি।
![]() |
| মহানবী সাঃ এর জীবনী সম্পুর্ন বাংলা ভাষায় অনুবাদ |
ভাবের আবেশ যখন অত্যন্ত গভীর হয়ে উঠল তখন আর তিনি গৃহে থাকতে পারলেন না। কি একটা অস্ফুট আকুল প্রেরণা, কি একটা মর্মস্পর্শী অজেয় কৌতূহল যেন থেকে থেকে তাঁকে অভিভূত করে তুলতে লাগল। কস্তুরীমৃগ যেমন 'আপন সুগন্ধে আপনি আত্মহারা হয়ে উঠে, তদ্রূপ তিনিও পবিত্র ভাবোচ্ছ্বাসে ব্যাকুল হয়ে উঠলেন। তিনি যেন রহস্যালোকে উধাও হয়ে যেতে লাগলেন। সংসারের কর্ম-কোলাহলে পাছে তাঁর এ আধ্যাত্ম জীবন ব্যর্থ হয়ে যায়, সামাজিক আবিলতার মধ্যে পরে সেই পবিত্র ভাবের গতিস্রোত রুদ্ধ হয়ে পড়ে, এ আশঙ্কায় তিনি মক্কার অনতিদূরে 'হিরা' নামক এক পর্বত-গুহায় নির্জন স্থানে ধ্যান মগ্ন হলেন।
হযরত খাদীজা ছিলেন অতি বুদ্ধিমতী ধার্মিকা মহিলা। স্বামীর ভিতরে যে একটা বিপুল অন্তবিপ্লব চলতেছে, এ বিপ্লব যে ক্রমে ক্রমে একটা শুভ পরিণতির দিকে অগ্রসর হতে াসছে, তা তিনি উত্তমরূপেই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। এজন্যই তিনি প্রকৃত সহধর্মিণীর ন্যায় স্বামীর এই কাজে পূর্ণ সহযোগিতা করতে লাগলেন। হযরত খাদীজা দুই তিন দিন চলতে পারে এই পরিমাণ খাদ্য ও পানীয় প্রস্তুত করে তাঁকে দিয়ে দিতেন। আহার্য নিঃশেষ হয়ে গেলে তিনি বাড়ী এসে পুনরায় ঐরূপ খাদ্য সামগ্রী নিয়ে যেতেন।
এরূপে নির্জন হিরা-গহ্বরে বসে তিনি অদ্বিতীয় সর্বশক্তিমান আল্লাহর 'ইবাদত বন্দেগীতে রত থাকতেন। তখনও তিনি নবী হন নি, কুর'আনও অবতীর্ণ হয় নি, 'ইবাদত কিভাবে করতে হয় তাও তিনি অবগত হতে পারেন নি; তবে কিরূপে কি 'ইবাদত করতেন?
তিনি কি 'ইবাদত করতেন?
তিনি (ভূমণ্ডল ও নভোমণ্ডলস্থিত সৃষ্ট পদার্থসমূহ নিরীক্ষণ করে আল্লাহর অস্তিত্বের) গবেষণা এবং ধ্যান করতেন।"
তিনি নিরবচ্ছিন্নভাবে বহুদিন পর্যন্ত এই রূপ ধ্যান ধারণায় নিমগ্ন রইলেন। এই ধ্যান রাজ্যে অবস্থানকালে তাঁর আত্মার স্তরে স্তরে নিরাকার মা'শুকের প্রত্যক্ষ অনুভূতি জেগে উঠেছিল, অদৃশ্য কোমল করাঙ্গুলির সংস্পর্শে তাঁর হৃদয়ের তন্ত্রে তন্ত্রে যে স্পন্দন আরম্ভ হয়েছিল, তা শুধু অনুভব করার বস্তু, লেখনী দ্বারা ব্যক্ত করার নয়।
হিরার চতুর্দিকে জনমানবশূন্য বিস্তৃত 'গন্তর। সূর্যের কিরণ চন্দ্রের জ্যোতি, নক্ষত্ররাজির আলো, মুক্ত স্নিগ্ধ সমীকরণ ব্যতীত সেখানে তাঁর আর কেউ সহচর ছিল না। সুতরাং তিনি একনিবিষ্ট চিত্তে তত্ত্বাসন্দিৎসু দৃষ্টিতে সৃষ্টির প্রত্যেকটি বস্তুর প্রতি গভীরভাবে লক্ষ্য করে স্রষ্টার অস্তিত্ব, মহত্ত্ব, একত্ব এবং তাঁর পরিচয় ও প্রেম লাভের ধ্যানে অভিভূত হয়ে পড়তেন।
রাসূল (সাঃ)-এর প্রপিতামহ হযরত ইব্রাহীম (আঃ) নবুওয়ত প্রাপ্তির পূর্বে যেভাবে ধ্যান-ধারণার সাহায্যে আল্লাহর 'ইবাদতে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন, তিনিও হিরা পর্বতের গুহায় অবস্থান, কালে তদ্রূপ 'ইবাদতেই রত হয়েছিলেন। হযরত ইব্রাহীম (আঃ) সর্বপ্রথম জ্যোর্তিময় নক্ষত্র দেখে একে প্রভু বলে সন্দেহ করেন। তৎপর চন্দ্র দেখে তাঁর মনে আরও অধিক সন্দেহের উদ্রেক হয়। পরিশেষে সূর্য দেখে তদপেক্ষা প্রবল ধারণা জন্মে। কিন্তু সকলই যখন অদৃশ্য হয়ে গেল তখন তিনি বলে উঠলেন- "যা অদৃশ্য হয়ে যায়, আমি তাকে ভালোবাসি না। (অর্থাৎ নশ্বর বস্তুকে আমি প্রভু বলে বিশ্বাস করি না।)"
"আমি একনিষ্ঠভাবে তার দিকে মুখ ফিরাতেছি যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন।"
মানবজাতির দৈহিক ও অধ্যাত্মিক শক্তি অতি দুর্বল। জ্যোর্তিময় ফেরেশতার সন্দর্শন এবং তাঁর নিকট হতে ওহীরূপ গুরুভার গ্রহণ করতে মানবশক্তি অক্ষম। তাই রাসূল (সাঃ)-এর হৃদয়কে ওহী গ্রহণের উপযোগী শক্তিশালী করে তুলার জন্য আল্লাহ তা'আলা তাঁর অন্তরে নির্জনে বসে ধ্যান ধারণা ও অধ্যাত্মিক সাধনার অদম্য প্রেরণা দান করেছিলেন। বাষ্পরাশি যেমন ক্রমান্বয়ে পুঞ্জীভূত হয়ে শক্তি অর্জন করতে থাকে, যখন উপযুক্ত মাত্রায় পৌছে তখন মেঘাকারে স্নিগ্ধ মধুর সলিলধারা বর্ষণ করে ধরণীবক্ষকে অভিষিক্ত করে, তদ্রপ রাসূল (সাঃ)-এর হৃদয়ও ধ্যান ধারণা এবং গভীর সাধনার দ্বারা ক্রমশঃ শক্তিশালী হতে লাগল। যেন ওহীর গুরুভার গ্রহণ করত রাহমতুল্লিল 'আলামীনরূপে করুণাবারি বর্ষণ করে মানব সমাজের তাপিত প্রাণ শীতল করতে পারেন।
সর্বপ্রথম নবুওয়তের উপক্রমণিকারূপে মুহাম্মদ মুস্তফা (সাঃ)-এর মধ্যে যা প্রকাশ পেল তা হল সত্য স্বপ্ন। হাদীসে আছে-
"হযরত 'আয়িশা হতে বর্ণিত আছে। রাসুল (সাঃ) প্রথম প্রথম নিদ্রিতাবস্থায় সত্য স্বপ্নরূপে ওহী প্রাপ্ত হতে লাগলেন। প্রত্যেক স্বপ্নই প্রভাতের শুভ্র রশ্মির ন্যায় স্পষ্টতঃ প্রত্যক্ষীভূত হত।"
পয়গম্বরগণের স্বপ্নও ওহীর অন্তর্ভুক্ত। কারণ, নিদ্রিত অবস্থায় তাঁর নূরানী অন্তকরনে যা প্রতিফলিত ও অনুভূত হয় তা জাগ্রত অবস্থার ন্যায় ধ্রুব সত্য ও বাস্তব হয়ে থাকে। এজন্যই হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে যে, আমরা নবী সম্প্রদায়, আমাদের চক্ষু নিদ্রাভিভূক্ত হয়, কিন্তু আমাদের অন্তর নিদ্রাভিভূত হয় না।
স্বপ্নযোগে, জাগ্রত অবস্থার মাধ্যমে বিহনে অথবা জিবরা'ঈল ফেরেশতার মাধ্যমে, এই তিন প্রকারেই নবী-রাসূলগণের নিকট ওহী এসে থাকে। প্রথম প্রকারের ওহী দ্বারা আল্লাহ তা'আলা তাঁদের অন্তকরণের জ্যোতি ও শক্তি বৃদ্ধি করে অপর দ্বিবিধ ওহী প্রেরণ করেন। হাদীসে আছে- "সত্য স্বপ্ন নবুওয়তের ছয় চল্লিশ ভাগের একভাগ।"
পয়গম্বরগণ ওহী দ্বারা অদৃশ্য বিষয়সমূহ অবগত হয়ে থাকেন, সত্য স্বপ্ন দ্বারাও অদৃশ্য বিষয়সমূহ অবগত হতে পারা যায়। এজন্যই সত্য স্বপ্নকে নবুয়তের ছয়চল্লিশ ভাগের এক ভাগ বলা হয়েছে। বাসুল (সাঃ)-এর নিকট স্বপ্নযোগে কত দিন পর্যন্ত ওহী এসেছিল তা সহীহ্ কিতাবসমূহের রিওয়ায়তে পাওয়া যায় না। অবশ্য বায়হাকী বর্ণনা করতেছেন যে, ছয় মাস পর্যন্ত স্বপ্ন যোগে ওহী এসেছিল।
যখন রাসূল (সাঃ)-এর বয়স চল্লিশ বছর হল তখন জিব্রাঈল ফেরেশতা আল্লার ওহী নিয়ে তাঁর সম্মুখে উপস্থিত হলেন
এবং প্রকাশ্যভাবে তিনি নবুওয়ত প্রাপ্ত হলেন। সে দিন ১৭ রমযান সোমবার ছিল।
কুর'আন মজীদে আছে-
"রমজান মাস যাতে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে।"
"আমি তা (কুরআন) কদরের রাত্রিতে অবতীর্ণ করেছি।"
হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সাঃ) একদিন হেরার অপ্রশস্ত নিভৃত গহবরে ধ্যানমগ্ন আছে-সকল প্রাণ ঢেলে দিয়ে আবেশ অবশহৃদয়ে ভাবের আকুল স্রোতে অনন্তের দিকে ভেসে চলেছেন। এমন সময় হঠাৎ শুনতে পেলেন, কে যেন তাঁকে ডাকতেছেন: মুহাম্মদ (সাঃ)।
তাঁর সারা শরীর রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল। তিনি চক্ষু খুলে দেখতে পেলেন, এক জ্যোতির্ময় ফেরেশতা তাঁর সম্মুখে দণ্ডায়মান। সে ফেরেশতার অভিনব জ্যোতিতে সারা গুহা আলোকিত হয়ে উঠেছে। ইনিই আল্লাহর বাণীবাহক ফেরেশতা জিবরা'ঈল (আঃ)।
হযরত জিবরাঈল (আঃ) তাঁকে বললেন: আপনি পাঠ করুন। রাসূল (সাঃ) কম্পিত কণ্ঠে উত্তর করলেন: "আমি ত পড়তে জানি না।" হযরত জিব্রাঈল (আঃ) তাঁকে সজোরে জড়ায়ে ধরে আলিঙ্গন করলেন। ছেড়ে দিয়ে আবার বললেন, পড়ুন। তিনি পূর্ববৎ উত্তর দিলেন। তিন বারই এরূপ করলেন। শেষ বার ছেড়ে দিয়ে হযরত জিব্রাঈল (আঃ) বললেনঃ "হে রাসূল, আপনি স্বীয় প্রভুর নাম নিয়ে কুর'আন পাঠ করুন, যিনি সবকিছু সৃষ্টি করেছেন। যিনি মানুষকে জমাট রক্তের টুকরা হতে পয়দা করেছেন। আপনি কুরআন পাঠ করুন আর আপনার প্রভু অতিশয় উদার। যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন। মানুষকে ঐ সমস্ত বিষয়ের শিক্ষা দিয়েছেন যা সে জানত না।"
কুর'আনের এ আয়াতগুলোই সর্বপ্রথম অবতীর্ণ হল। রাসূল (সাঃ) আয়াতগুলো নিয়ে প্রত্যাবর্তন করলেন। তখন তাঁর হৃৎপিণ্ড স্পন্দিত হচ্ছিল। তিনি একেবারে অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন। অদৃশ্য নূরাণী ফেরেশতার প্রথম সাক্ষাৎ, মহাসত্যের প্রথম প্রকাশ, সৃষ্ট জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ পদ রিসালাতের গুরুদায়িত্ব ভার গ্রহণ, এসময় তাঁর হৃদয়ে যে কি ভাবের উদয় হয়েছিল, তা কিরূপে বর্ণনা করব। ভক্তের প্রীতিপূর্ণ হৃদয় দিয়ে তা শুধু অনুভব করারই বস্তু, বণনা করার নয়।
তিনি প্রকম্পিত হৃদয়ে হযরত খাদীজার নিকট উপস্থিত হয়ে বললেনঃ আমায় আবৃত কর, আমায় আবৃত কর। আমার বড় ভয় হচ্ছে। তখন হযরত খাদীজা কম্বল দ্বারা তাঁকে আবৃত করে দিলেন এবং পার্শ্বে বসে তাঁকে সান্ত্বনা ও অভয় দিতে লাগলেন।
ক্ষাণিক পরে তিনি একটু প্রকৃতিস্থ হলেন এবং হিরা গহ্বরের সমস্ত ঘটনা হযরত খাদীজার নিকট খুলে বললেন। তৎসঙ্গে তাও বললেন যে, আমার সম্বন্ধে আমার ভয় হচ্ছে। আল্লাহর কসম, আল্লাহ্ তা'আলা কখনই আপনাকে অপদস্থ করবেন না। আপনি আত্মীয়-স্বজনের সাথে সদ্ব্যবহার করে থাকেন, আপনি সত্য কথা বলেন, আপনি রোগগ্রস্ত, দুর্বল বিধবা, ইয়াতীম প্রভৃতি অসচ্ছল লোকদের ব্যয়ভার বহন করেন, যারা উপার্জন করতে অক্ষম-তাদেরকে সাহায্য করেন, অতিথি সেবা করেন, আপনি নিয়তির নির্ধারিত মহাবিপদে পতিত লোকদেরকে সাহায্য করে থাকেন। তবে কেন আল্লাহ তা'আলা আপনার প্রতি বিমুখ হবেন। আমার বিশ্বাস আপনার এই ঘটনার মধ্যে কোন মহান উদ্দেশ্য নিহিত আছে।
যাঁর হৃদয় পবিত্র, বিবেক-বুদ্ধি সুস্থ, তিনি এভাবেই সত্যকে উপলব্ধি করতে সমর্থ হন। যে যুগে ধর্ম বলতে কিছু ছিল না, ধর্মের আলোচনা শুনার কোন উপায় ছিল না, হযরত খাদীজা সে অন্ধ যুগের অন্তঃপুর বাসিনী নারী। তিনি নিজের বিবেক দ্বারা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে, আল্লাহর প্রতি যাঁর অটল বিশ্বাস আছে, যিনি সর্বদা সত্য কথা বলেন, পুণ্য ও জনহিতকর কাজ করেন, তাঁকে অমঙ্গল স্পর্শও করতে পারে না। তিনি কখনই অপদস্থ হতে পারেন না, কোন বিষয়েই তাঁর শঙ্কিত হবার বা ভয় পাবার কারণ নেই। হৃদয়ের এই পবিত্র এবং জ্ঞানের এত গভীরতা আছে বলেই হযরত খাদীজা (রাঃ) সমাজের নিকট হতে 'তাহিরা' উপাধিপ্রাপ্ত হয়েছিলেন এবং সৃষ্টসেরা মহামানবের সহধর্মিণী হবার সৌভাগ্য লাভ করতে পেরেছিলেন।
হযরত খাদীজা (রাঃ)-এর এই প্রবোধ বাণী হতে প্রতীয়মান হচ্ছে যে, নবুয়তের পূর্বেও রাসূল (সাঃ) আজীবন সত্য, পুণ্য এবং জনহিতকর কাজে নিজেকে বিলায়ে দিয়েছিলেন। এক মুহূর্তের তরেও তার বিপরীত কিছু করেন নি। সুতরাং এই কাজগুলো রাসূল (সাঃ)-এর আজীবনের সুন্নত। তাঁর অনুসরণকারী প্রত্যেক মুসলমানের এ সুন্নতগুলো পালন করা উচিত।
কিন্তু মুসলমানগণ আজ এ বিষয়ে অত্যন্ত উদাসীন।
হযরত খাদীজা (রাঃ) প্রাণপণে স্বামীকে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন। রাসূল (সাঃ)-এর মন হতে তবু ভয় দূর হল না। তখন তিনি তাঁকে চাচাতো ভাই ওরাকা বিন নওফলের নিকট নিয়ে গেলেন। হযরত খাদীজা (রাঃ) ওরাকাকে বললেন: ভাই জান, আপনার ভ্রাতুষ্পুত্র মুহাম্মদ (সাঃ) কি বলতেছেন, শুনুন। তখন ওরাকা তাঁকে বললেন: প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্র, আপনি কি দেখলেন, বলুন। অনন্তর রাসূল (সাঃ) সমস্ত ঘটনা খুলে বললেন।
জ্ঞানবৃদ্ধ তাপস সমস্ত ঘটনা অবগত হয়ে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে উঠলেনঃ "হযরত মূসার প্রতি আল্লাহ তা'আলা যে নামূসে আকবর (জিব্রাঈল আঃ) কে প্রেরণ করেছিলেন, ইনি সে নামুসে আকবর। হে মুহাম্মদ (সাঃ), যখন আপনি কুরায়শদেরকে সত্য ধর্মের দিকে আহ্বান করবেন তখন যদি আমি যুবক হতাম, হে মুহাম্মদ (সাঃ) যখন আপনার গোত্রের লোকেরা আপনাকে দেশান্তর করবে তখন যদি আমি বেঁচে থাকতাম, তবে নিশ্চয়ই আমি আপনাকে প্রাণ দিয়ে সাহায্য করতাম।"
রাসূল (সাঃ) ওরাকার কথায় অত্যন্ত বিস্মিত হয়ে বললেন: আমার বংশদর কি আমাকে দেশ হতে তাড়িয়ে দিবে? ওরাকা বললেন: নিশ্চয়ই, হে মুহাম্মদ (সাঃ) আপনি যে সত্য প্রাপ্ত হয়েছেন, যখনই কেউ এই সত্য নিয়ে আবির্ভূত হয়েছেন তখনই তাঁর স্বগোত্রীয়গণ তাঁর সাথে শত্রুতা করেছে। সুতরাং আপনার স্বগোত্রীয়গণ যে আপনার সাথে শত্রুতা করবে এতে আর সন্দেহ কি? সে-দিন যদি আমি বেঁচে থাকতাম তবে আমার সমস্ত ক্ষমতা দিয়ে আপনাকে সাহায্য করিতাম। কিন্তু এরপর ওরাকা আর বেশী দিন বেঁচে রইলেন না। আর বিশেষ কোন শুভ কারণে কিছু কালের জন্য ওহী অবতীর্ণ হওয়া বন্ধ রইল।
হযরত জিব্রাঈলকে দেখে রাসূল (সাঃ) অত্যন্ত ভয় পেয়েছিলেন। এজন্যই হযরত খাদীজা (রাঃ) নানা প্রকার সান্ত্বনা বাণী দ্বারা তাঁর ভীতি দূর করতে চেষ্টা করেছিলেন। এবং ওরাকার নিকটও নিয়ে গিয়েছিলেন।
এতে পাঠকের মনে এই সন্দেহ জেগে উঠতে পারে যে, এই আয়াতগুলো যে কুর'আন তা হয়ত তখন তিনি বুঝতে পারেন নি। নতুবা এত শঙ্কিত হবার কোন কারণ ছিল না। বস্তুতঃ এ সন্দেহ ঠিক নয়। কারণ এই আয়াতগুলো যে আল্লাহ কর্তৃক প্রেরিত ওহী এবং কুর'আন, এ-কথার প্রতি তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল। আল্লাহ্ তা'আলা তাঁর অন্তরে এজ্ঞান সম্যকরূপে জন্মায়ে দিয়েছিলেন। তিনি স্বতঃসিদ্ধভাবেই এ বিষয়ে অবগত ছিলেন।
তখন যে তিনি ভীত হয়েছিলেন, তা আর কিছুই নয়, তা ছিল শুধু নবুওয়তরূপ দায়িত্বের গুরুভারের আতঙ্ক, আর মানব-প্রকৃতি সম্ভূত অনিচ্ছাকৃত ত্রাস। বিদ্যুৎ প্রবাহের প্রথম স্পর্শে যেমন বিদ্যুৎ-শলাকায় স্পন্দন জেগে উঠে, চির জ্যোতির্ময়ের প্রথম স্পর্শে তাঁর মানব-হৃদয়ে তদ্রূপ কম্পনই জেগে উঠেছিল।
ওহীরূপ গুরুভারের চাপ যে কত তীব্র। বেগ যে কত প্রবল। নূরানী ফেরেশতার অপরূপ জ্যোতির্ময় বিরাটকায় মূর্তি দর্শন, তাঁর আকস্মিক আলিঙ্গন এবং তাঁর সাথে কথোপকথন যে কি ভীষণ ব্যাপার তা কি লেখনী দ্বারা প্রকাশ করা সম্ভবপর? ওরাকার নিকট জিজ্ঞেস করা সন্দেহ ভঞ্জন বা অন্য কোন কারণে ছিল না, শুধু আতঙ্কিত হৃদয়ে স্থিরতা ও শান্তি আনয়ন এবং দৃঢ়তা সাধনই ছিল তার একমাত্র কারণ।
প্রতিদিন পাঠকের মনে আরও কয়েকটি সন্দেহ জাগতে পারে, তা এই-
- রাসূলুল্লাহ লেখা-পড়া জানতেন না, তিনি ছিলেন উম্মী (নিরক্ষর)। এমতাবস্থায় জিবরাঈল তাঁকে পড়তে নির্দেশ দেবার অর্থ কি? ক্ষমতা বহির্ভূত কাজের আদেশ দেবার কি সমীচীন হল?
- জিব্রাঈল তাঁকে বলেছিলেন, "আপনি আল্লাহর নাম নিয়ে কুরআন পাঠ করুন।" এতে মনে হয় যে, এ আদেশবাচক বাক্যটি পাঠ করার জন্য রাসূল (সাঃ) আদিষ্ট ছিলেন না। অতএব, এই বাক্যটি কুরআনের অংশ নয় এবং তা পাঠ কালে আল্লাহর নাম নেওয়া বা বিস্মিল্লাহ পড়াও ওয়াজিব হবে না।
- হযরত জিবরাঈল তাঁকে পড়তে আদেশ দিলেন। কিন্তু কি পড়বেন, তা বলে না দিয়েই তিনি তাঁকে জড়ায়ে ধরে আলিঙ্গন করতে লাগলেন। তাও একবার নয় বরং তিন বার। এরূপ করার কারণ কি?
- যে শিশু লিখতে পড়তে জানে না, 'আলিফ', 'বা'ও পড়তে শিখে নি, প্রাথমিক বর্ণ পরিচয়ের সময় ওস্তাদ তাকে বলে থাকেন: পড় আলিফ, বা এস্থলে কেউ বলবে না যে, এ শিশুকে ক্ষমতাতীত কাজের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। হযরত জিবরাঈলের নির্দেশ এরূপই ছিল। কিন্তু কি পড়তে হবে রাসূল (সাঃ) তা স্থির করতে পারেন নি, অথবা লেখা দেখে তিনি পড়তে শেখেন নি, এজন্যই হয়ত তিনি "আমি পড়তে জানি না" বলে আপত্তি করেছিলেন।
- হযরত জিবরাঈল (আঃ) তিন বারই বলেছিলেন-"আপনি কুর'আন পড়ুন।" কিন্তু কুর'আন যে কি, তা তিনি বলেন নি। তৃতীয় বারের আদেশ ও আলিঙ্গনের পর বললেন।। যে কুরআন পাঠ করার জন্য আমি আপনাকে নির্দেশ দিতেছি তা হল: "আপনি স্বীয় প্রভুর নাম নিয়ে কুর'আন পাঠ করুন। সুতরাং এ আয়াতটি আল্লাহর ওহী এবং কুর'আনের অংশ এতে আর সন্দেহের কোন কারণ নেই। অথবা মনে করুন, কেউ বলল: "আমি যা বলি তা মনোযোগ দিয়ে শুন।" এস্থলে এই আদেশবাচক বাক্যটিও শ্রবণ করা উদ্দেশ্য হয়ে থাকে। তদ্রূপ "পাঠ করুন" বাক্যটি পাঠ করার জন্য রাসূল (সাঃ) আদিষ্ট হয়েছিলেন। আর যা পাঠ করার জন্য আদিষ্ট হয়েছিলেন তাই আল্লাহর অবতারিত ওহী বা কুরআন।
- মওলানা থানডী (রহঃ) বলেন, ওহী আয়ত্ত করার মত তাঁর মানসিক ক্ষমতা পরিপুষ্ট করে তুলার জন্যই হয়ত হযরত জিবরাঈল (আঃ) তাঁকে এভাবে তিনবার জড়ায়ে ধরেছিলেন। 'আল্লামা কুসতলানী বলেন: জিব্রাঈল (আঃ) যে ওহী পৌঁছাতে এসেছিলেন, তা অতি দায়িত্বপূর্ণ গুরুভার ছিল। তা গ্রহণ করতে পূর্ণ মনোযোগের আবশ্যক ছিল। অতএব এ প্রক্রিয়া দ্বারা হযরত জিবরাঈল (আঃ) তাঁর অন্তর হতে দুনিয়ার সমস্ত খেয়াল দূর করে দিয়ে ওহী আয়ত্ব করার প্রতি তাঁর মনোযোগ আকর্ষণ করেছিলেন। এজন্যই শিক্ষাকালে যেন ছাত্রগণ পূর্ণ মনোযোগ সহকারে শিক্ষা গ্রহণ করে তৎপ্রতি শিক্ষকের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখা উচিত।
পরিশেষেঃ
প্রিয় পাঠক, আজকের আর্টিকেলের মাধ্যমে আমরা বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর জীবনী সিরিজ পর্বের ষষ্ঠ পর্ব শেষ করেছি। এই সিরিজের ৭ম পর্বটি পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন।
