মহানবী সাঃ এর জীবনী | Mohammad The Final Legacy. Ep-05
আসসালামু আলাইকুম, প্রিয় পাঠক আজকের আর্টিকেল এর মাধ্যমে আমি আপনাদের সাথে শেয়ার করবো মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর সম্পুর্ন জীবনী বাংলা সিরিজ এর ৫ম পর্ব সম্পর্কে। আপনি যদি 'মহানবী সাঃ এর সম্পুর্ন জীবনী' এই সিরিজে নতুন হয়ে থাকেন এবং ৪র্থ পর্বটি পড়তে চান তাহলে এখানে ক্লিক করে আগের পর্বটি পড়ে নিতে পারেন। চলুন আজকের পর্ব শুরু করা যাক-
মহানবী সাঃ এর সাংসারিক জীবন
হযরত খাদীজা তাঁর যথাসর্বস্ব ভক্তিভাজন স্বামীর চরণে বিলায়ে দিয়েছেন। রাসূল (সাঃ) এখন সংসারী সেজেছেন। এখন হযরত খাদীজার বিশাল বাণিজ্যের ভার তাঁর হাতে ন্যস্ত। তিনি স্বয়ং বাণিজ্য বিভাগের সমস্ত বিষয়ের তত্ত্বাবধান করতেছেন। কোন সময় নিজেও পণ্য-দ্রব্য নিয়ে দেশ-বিদেশে বাণিজ্য করতে যেতেন।
বাণিজ্য অর্থোপার্জনের সর্বশ্রেষ্ঠ উপায়। অর্থই হল দীন ও দুনিয়ার সমস্ত পূর্ণকর্ম সমাধানের প্রধানতম উপকরণ। সুতরাং যিনি হবেন নিখিল বিশ্বের আদর্শ, বাণিজ্যের প্রতি তাঁর আকর্ষণ থাকা অতি স্বাভাবিক। বাণিজ্যের মধ্য দিয়ে নানা
দেশের নানা বৈচিত্রা প্রত্যক্ষ করার এবং নানা মানুষের নানা মনোভাবের সাথে নিত্য নূতন পরিচয় লাভ করার পূর্ণ সুযোগ পাওয়া যায়। আবার সততা, বিশ্বস্ততা, দূরদর্শিতা, মিতব্যয়িতা ও সাবলম্বন ইত্যাদি অভ্যন্তরীন বহু সুপ্ত প্রতিভা সুষ্ঠভাবে বিকশিত হয়ে উঠে এজন্যই তিনি বাণিজ্যের প্রতি আনুরক্ত ছিলেন।
![]() |
| মহানবী সাঃ এর সম্পুর্ন জীবনী |
তিনি বাণিজ্য উপলক্ষে পূর্ববর্ণিত সিরিয়া ও বুসরা ব্যতীত আরও বহু দেশে গমন করেছিলেন। জআশেস্তা, জরণ, বহরায়ন প্রভৃতি স্থানেও বাণিজ্য-ভ্রমণ করেছিলেন। এ সকল দেশের বহু লোকের সাথে তাঁর পরিচয় হয়েছিল। নবুওয়ত যুগে যখন বাহরায়নের 'আবদুল কয়স্ গোত্রের প্রতিনিধি দল রাসূল (সাঃ) -এর খিদমতে উপস্থিত হলেন তখন তিনি সেই দেশের অনেক স্থানের অবস্থা তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন। তখন তাঁরা আশ্চর্যন্বিত হয়ে বলতে লাগলেন: হুযূর, আপনি আমাদের দেশের অবস্থা আমাদের চেয়েও বেশী অবগত আছেন।" তখন তিনি বললেনঃ "হাঁ, আমি তোমাদের দেশে অনেক ভ্রমণ করেছি।"
সংসারের মায়াজালে জড়ায়ে লক্ষ্যভ্রষ্ট হতে পারেন এ আশঙ্কায় অনেক মহাপুরুষই সংসার ত্যাগ করে বনবাসী সন্ন্যাসী সেজে থাকেন। কিন্তু আমাদের মহানবী (সাঃ) তদ্রূপ বৈরাগ্য পছন্দ করেন নি। কারণ, সমস্ত মানব-সমাজকে ভব-সমুদ্রে ডুবন্ত অবস্থায় রেখে একা একা ভব পার হওয়ার বিশেষ কোন মূল্য তাঁর নিকট ছিল না। যে ব্যক্তি সংসারের চতুর্মুখী অভাব অভিযোগে পড়েন নি, বিভিন্ন মেজাজের পরিবার-পরিজনের মন রক্ষা করার কঠোর সমস্যা যার সমাধান করতে হয় নি, সর্বসাধারণের কাঁধে কাঁধ মিলায়ে যে ব্যক্তি জানাযায়, 'ঈদে, জুমা'আর জামা'আতে উপস্থিত হতে পারে না, বিপদে আপদে পাড়া প্রতিবেশীর সাহায্য করা এবং দেশ ও সমাজের খিদমত করা যার সৌভাগ্যে ঘটে না, এরূপ লোকের সাধু জীবনের মূল্য অতি অল্প। সংসারী হয়ে সর্বসাধারণের সাথে মিলা-মিশা করে কর্মক্ষেত্রের ভিতর দিয়ে যে ব্যক্তি সততা ও ধার্মিকতা রক্ষা করে চলতে পারে, আল্লাহর দরবারে তার মর্যাদা অনেক বেশী।
রাসূল (সাঃ) এখন বিরাট সম্পত্তির অধিকারী। তাঁর ধন-দৌলতের কোন অভাব নেই। ভোগ বিলাসের সমস্ত উপকরণ বিদ্যমান আছে। কিন্তু কোন আকর্ষণই তাঁকে লক্ষ্য ভ্রষ্ট করতে পারে নি। কি অসীম মনোভাব এ মহাপুরুষের। কি অপূর্ব আত্মসংযম এ মহাপুরুষের। কর্মক্ষেত্রের ভিতর দিয়ে ন্যায় ও সত্যের প্রতিষ্ঠা, মানব সমাজকে ভ্রাতৃত্ববন্ধনে আবন্ধ করা এবং সর্বপ্রকার অশান্তি দূর করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করাই ছিল তাঁর একমাত্র লক্ষ্য।
বাণিজ্য-ক্ষেত্রে যাঁরা তাঁর সহকর্মী ছিলেন, কায়স্ ইবন সায়িব তাঁদের অন্যতম। প্রসিদ্ধ তফসীরকার মুজাহিদ ইবন জবরা কায়সেরই গোলাম ছিলেন। মুজাহিদ বলেন: বাণিজ্যক্ষেত্রে যাঁরা রাসূল (সাঃ)-এর সাথে কারবার করতেন তাঁদের সাথে তিনি বাণিজ্য সংক্রান্ত সমস্ত বিষয় অতি পরিষ্কার রাখতেন। কখনও কোন প্রকার ঝগড়া বা মনোমালিন্যের কারণ ঘটে নি।
রাসূল (সাঃ)-এর সততা, বিশ্বস্ততা ও সচ্চরিত্রতার প্রতি মুগ্ধ হয়ে বহু সহকর্মীই তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধুতে পরিণত হয়েছিলেন। তন্মধ্যে হযরত আবূ বকর, হাকীম বিন হিযাম, যাম্মাদ বিন সা'লাবা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। রাসূল (সাঃ)-এর তৎকালীন বন্ধুগণ সকলেই চরিত্রবান এবং মহৎ লোক ছিলেন।
"কবুতর কবুতরের সাথে, বাজ বাজের সাথে, সমজাতীয় সমজাতীয়ের সাথে উড়ে থাকে।"
Birds of the same feathe. flock together
"একই পালকবিশিষ্ট পাখী একই ঝাঁকে চলে।"
হযরত আবূ বকর (রাঃ) বহু বছর যাবৎ মহানবী (সাঃ)-এর সাহচর্যে ছিলেন। সাধারণতঃ দেখা যায় দীর্ঘ মিলন মনোমালিন্য ও বিচ্ছেদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এজন্যই বলা হয়ে থাকে-
"মাঝে মাঝে ফাঁক দিয়ে বন্ধুর সাথে সাক্ষাৎ কর, তবেই তোমার ভালোবাসা বৃদ্ধি পাবে।"
কিন্তু এখানে তার সম্পূর্ণ বিপরীত। এ দুই মহামনীষীর মিলন যতই অধিক হত ততই, তাঁদের বন্ধুত্ব গাঢ় হতে থাকত। প্রতিভাশীল আবু বকর রাসূল (সাঃ)-এর সাহচর্যে যে মধুর সন্ধান পেয়েছিলেন তার মাধুর্য কোন দিনই বিলীন হবার বস্তু ছিল না। এ মাধুর্য-যতই অধিক পরিমাণে পান করা যায় ততই এর প্রতি অনুরাগ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে থাকে।
মুহাম্মদ নাম যতই যপি ততই মধু লাগে
নামে এত মধু আছে কে জানত আগে।
কবি যাঁর নামের মধ্যেই এমন 'মধুর' সন্ধান পেয়েছিলেন। জানি না, হযরত আবু বকর যে তাদের সাহচর্যে কেমন মধুর সন্দান পেয়েছিলেন।
হাকীম ইবন হিযাম ছিলেন হযরত খাদীজার চাচাত ভাই। ইনি সেই সময় কুরায়েশদের বিশিষ্ট মাননীয় সরদার ছিলেন। তখন হারাম শরীফের 'রিফাদা'-এর (হজ্বযাত্রীদের পানাহারের ব্যবস্থার) এবং 'দারুন নদওয়া' নামক সভাগৃহের কর্তৃত্বের ভার তাঁর হাতে ন্যস্ত ছিল। ইসলামী যুগে এক লক্ষ দিরহামের (তৎকালীন রৌপ্য মুদ্রার) বিনিময়ে তিনি এই পদ দুটি হযরত মু'আবিয়ার নিকট বিক্রয় করে সমস্ত দিরহাম আল্লাহয় নামে গরীব দুঃখীকে দান করে দিয়েছিলেন। তিনি বয়সে রাসূল (সাঃ)-এর চেয়ে পাঁচ বৎসরের বড় ছিলেন।
আষ্টম হিজরী অতীত হতে চলল, এখনও হাকীম ইসলাম গ্রহণ করেন নি। এত দীর্ঘ কাল যাবৎ অমুসলমান থাকা সত্ত্বেও, রাসূল (সাঃ)-এর সাথে তাঁর যে অকৃত্রিম ভালোবাসা ছিল, তাতে একটু ভাটা পড়ে নি। একবার কা'বা শরীফে অতি মূল্যবান একটি চাদর নিলামে বিক্রি হচ্ছে দেখে তিনি তা পঞ্চাশ আশরফী (তৎকালীন স্বর্ণ মুদ্রা) মূল্যে খরিদ করলেন। এ মূল্যবান চাদরখানা প্রাণের বন্ধু রাসূল (সাঃ)-কে উপহার দেওয়ার জন্য তাঁর মন ব্যাকুল হয়ে উঠল। সুতরাং তিনি সুদূর মদীনায় যেয়ে চাদরখানা উপটৌকনরূপে রাসূল (সাঃ) -এর খিদমতে পেশ করলেন। রাসূল (সাঃ) বললেন, "আমি মুশরিকের উপহার গ্রহণ করি না। অবশ্য মূল্য নিয়ে বিক্রয় করলে আমি তা রাখতে পারি। অগত্যা তিনি মূল্য নিতে বাধ্য হলেন।
হযরত যাম্মাদ আয়দ বংশীয় লোক ছিলেন। প্রাগৈসলামিক যুগে তিনি চিকিৎসা ও অস্ত্রোপচার ব্যবসা করতেন। ইনিও রাসূল (সাঃ)-এর অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন। নবুওয়ত যুগে তিনি একবার মক্কায় আগমন করলেন। মক্কায় এসে দেখতে পেলেন যে, রাসূল (সাঃ) যাচ্ছেন, আর তাঁর পিছনে বালকদের এক দল। মক্কার লোকেরা তখন তাঁকে পাগল বলে আখ্যা দিয়ে রেখেছিল 'বালকদেরকে দেখে তাঁরও এ ধারণাই জন্মিল। তিনি তাঁর নিকটে পৌছে বললেন: "হে মুহাম্মদ (সাঃ), আমি পাগলের চিকিৎসা করতে জানি।" এ কথা শুনে রাসূল (সাঃ) আল্লাহ প্রশংসার পর ওজস্বিনী ভাষায় তাঁকে কয়েকটি বাক্য শুনালেন। যাম্মাদ তৎক্ষণাৎ মুসলমান হয়ে গেলেন।
হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সাঃ) গৃহীবেশে জীবন যাপন করতেছেন। সত্যের আকাশে নবুওয়াত-রবি হওয়ার এখনও কিছু বাকী আছে। কিন্তু এখন হতে ফয়যে ইলাহীর ক্ষীণ কিরণ-রশ্মি দিকবিদিক্ বিকীর্ণ হতে আরম্ভ করল। পৌত্তলিকতা কুসংস্কার ও অন্ধ বিশ্বাসের নিবিড় অন্ধকারে আচ্ছাদিত জগতে তৌহীদের ক্ষুরণ দেখা দিতে আরম্ভ করল। 'আমরের পুত্র যায়দের কথা আমরা পূর্বেই বলেছি। পৌত্তলিকতার প্রতি তাঁর আদৌ, আস্থা ছিল না। তিনি সত্য ধর্মের খোঁজ করে বেড়াতেছিলেন। রাসূল (সাঃ)-এর সাথে তাঁর যে সাক্ষাৎকার ঘটেছিল, তাও পূর্বেই বর্ণিত হয়েছে।
তিনি ব্যতীত 'উবায়দুল্লাহ ইব্ন জাহাশ, "উসমান, কুস্ ইবন সাইদা এবং ওরাকা ইবন, আল-হুয়ায়রিসও পৌত্তলিকতা বর্জন করে সত্য ধর্মের অন্বেষণে ব্যাপৃত হলেন। পরে ওরাকা খৃষ্টধর্ম গ্রহণ করলেন। তিনি হযরত খাদীজার চাচাত ভাই ছিলেন এবং মক্কাতেই অবস্থান করতেন।
'আরবী সাহিত্য এবং কোন কোন ইতিহাসে উল্লেখ আছে যে, কুস ইবন সা'ইদা 'উকাযের মেলায় অতি মাধুর্যপূর্ণ ভাষায় একটি বক্তৃতা দান করেন। রাসূল (সাঃ) উক্ত সভায় উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু এতদূসম্পর্কে যতগুলো রিওয়ায়ত আছে, বর্ণনা-বিধান অনুযায়ী একটিও সত্য বলে প্রমাণিত হয় না, বরং সবগুলো রিওয়ায়তই জাল এবং হাতে গড়া।
শুধু সাংসারিক জীবনে নয়, বরং বাল্যকাল হতে নবুওয়ত প্রাপ্তি পর্যন্ত কোন সময়েই রাসূল (সাঃ) পৌত্তলিকতা বা অন্ধযুগের অন্য কোন কুসংস্কার পছন্দ করেন নি। চির দিনই তিনি এই সমস্ত শিরক বিদ'আতকে ঘৃণার চক্ষে দেখতেন। নবুওয়ত প্রাপ্তির পূর্বেই তিনি পৌত্তলিকতার নিন্দাবাদ এবং কুৎসা বর্ণনা করা আরম্ভ করে দিয়েছিলেন। বিশ্বস্ত বন্ধু বান্ধবদেরকে তিনি পুতুল-পূজা করতে কঠোরভাবে নিষেধ করতেন।
একবার কুরায়শগণ দেবতার নামে উৎসৃষ্ট মাংসসহ দেবতার প্রসাদিত খাদ্য রাসূলকে খেতে দিয়েছিল; কিন্তু তিনি তা খেতে অস্বীকার করেন। এ হাদিসটি সহীহ বুখারীর বাবুল মানাকিবে যায়দ ইবন 'আমরের বর্ণনাতে এবং সহীহ বুখারীর আরও কয়েক স্থানে বর্ণিত আছে। রাসূল (সাঃ) যে নবুওয়তের পূর্বে আজীবন পৌত্তলিকতাকে ঘৃণা করতেন, তাতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। সাংসারিক জীবনে একবার রাসূল (সাঃ) হযরত খাদীজার সাথে বলেছেন, আরবের সর্বশ্রেষ্ঠ ঠাকুর দেবতা লাৎ এবং 'উয়্যাকেও আমি পূজা করি না এবং কখনও করব না।
"উরওয়া বলেন, খুয়ায়লিদের কন্যা খাদীজার জনৈক প্রতিবেশী আমার নিকট বর্ণনা করেছেন, তিনি একদা শুনতে পেলেন যে, নবী করীম (সাঃ) খাদীজাকে বলতেছেনঃ হে খাদীজা। আল্লাহর কসম, আমি লাৎ ও 'উয্যার পূজা করি না। আল্লাহর কসম কখনও করব না। তদূত্তরে খাদীজা বললেন: বাদ দেন লাত, বাদ দেন 'উষ্যা অর্থাৎ তাদের নামও নিবেন না। খাদীজার প্রতিবেশী (রাবী) বলতেছেন যে, 'আরবগণ শয়নের পূর্বে যে দেবতার পূজা করত সে দেবতাই হল লাত এবং 'উয্যা।
রাসূল (সাঃ) অধিকাংশ গৃহকার্য স্বহস্তে সম্পন্ন করতেন। সুতরাং তাঁর খিদমতের জন্য হযরত খাদীজা তাঁকে একটি গোলাম দান করেছিলেন। গোলামটির নাম ছিল যায়দ ইবন হারিস। বলা বাহুল্য, তদানীন্তন পৃথিবীর সর্বত্র গোলাম-ব্যবসায়ের প্রথা প্রচলিত ছিল। হাটে বাজারে দাসদাসী ক্রয়-বিক্রয় হত। পৃথিবীময় দাস-দাসীর প্রতি অবাধ অত্যাচার ও উৎপীড়ন চলত। অনেক দুর্বৃত্ত অনেক সময় কোন ঝগড়া-ফাসাদ অথবা অন্য কোন সুযোগ উপলক্ষ করে যুক্ত মানুষকেও বলপূর্বক দাস দাসী বানায়ে নিত এবং বাজারে বিক্রয় করে অর্থোপার্জন করত।
যায়দও প্রকৃতপক্ষে গোলাম-বংশ সম্ভূত ছিলেন না। তিনি আরবের 'বনু কলব' বংশের লোক ছিলেন। বনু মা'আন গোত্র ছিল তাঁর মাতুল বংশ। তিনি একবার মাতুলালয়ে বেড়াতে গিয়েছিলেন। ঘটনাক্রমে সেখানে একটা লুট-তরাজ হল। এ ঘটনাসুত্রে তিনি বন্দী হয়ে শত্রুদের গোলামে পরিণত হলেন এবং তাঁকেও বিক্রয় করার জন্য 'উকাযের বাজারে হাজির করা হল।
ঘটনাক্রমে হযরত খাদীজা তাঁর চাচাত ভাই হাকমকে বললেন। ভাইজান, আপনি আমাকে একটা বুদ্ধিমান বিচক্ষণ গোলাম খরিদ করে দিন। তিনি 'উকাষের বাজারে যেয়ে যায়দকে দেখে পছন্দ করলেন এবং তাঁকে খরিদ করে হযরত খাদীজার হাতে সোপর্দ করলেন।
যখন রাসূল (সাঃ)-এর সাথে হযরত খাদীজার বিবাহ হল তখন তিনি রাসূল (সাঃ)-এর খিদমতের জন্য তাঁকে এ গোলামটি দান করলেন।
একবার যায়দ সিরিয়া দমন কালে নিজ জন্মভূমি বন্ধু কলব মহল্লার উপর দিয়ে অতিক্রম করতেছিলেন। তাঁর পিতা এবং তার পিতৃব্য তাঁকে দেখে চিনতে পারলেন এবং তিনি কি রূপে দাসে পরিণত হলেন, সমস্ত ঘটনা আদ্যোপান্ত তাঁর নিকট শুনতে পেলেন।
কিছু দিন পরে যায়দের পিতা হারিসা এবং তাঁর পিতৃব্য কা'আব যায়দের জন্য মক্কায় আসলেন। তাঁরা রাসূল (সাঃ)-এর খিদমতে উপস্থিত হয়ে বিনীতভাবে আরজ করলেনঃ যে মুহাম্মদ (সাঃ) আমরা, যায়দকে ফিরে পেতে চাই; দয়া করে আপনি তাঁকে দিয়ে দিন।
তদুতরে রাসূল (সাঃ) বললেন: এ সম্বন্ধে আমি যায়দকে সম্পূর্ণ অধিকার দান করলাম। ইচ্ছা করলে সে এখনই চলে যেতে পারে। পিতা-মাতার নিকট যেতে আমি তাকে কখনও বাধা দিব না। এ উত্তর শুনে পুত্রকে ফিরে পাওয়ার আসন্ন আনন্দে হয়ত তাঁর পিতা ও পিতৃব্যের হৃদয় পূর্ণ হয়ে উঠেছিল। কিন্তু তাঁদের আশা পূর্ণ হল না। কারণ, যায়দ রাসূল (সাঃ)-কে ছেড়ে পিতার সাথে দেশে ফিরে যেতে কিছুতেই রাযী হলেন না।
তখন তাঁর পিতা ও চাচা তাঁকে বলতে লাগলেন: তুমি গোলাম হয়ে থাকাকে কিরূপে পছন্দ করতেছ। মুক্ত হয়ে আমাদের সাথে চল; স্বাধীনভাবে মর্যাদার সাথে জীবন যাপন করতে পারবে। তখন যায়দ বললেনঃ গোলাম থাকি আর দাস থাকি, মোটকথা আমি তাঁকে ছেড়ে থাকতে পারব না।
আধ্যাত্মিক জগৎ-পিতার নিষ্কলুষ ও অকৃত্রিম স্নেহের যে শক্তিশালী আকর্ষণে যায়দের হৃদয় আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিল তার তুলনায় পিতৃবাৎসল্য এবং জগতের যে কোন স্নেহ ও ভালোবাসা অতি দুর্বল ও নগণ্য। সূর্যের আলোর সম্মুখে যেভাবে পৃথিবীর সমস্ত আলো নিষ্প্রভ হয়ে যায়, তদ্রূপ আল্লাহর হাবীবের ভালবাসার সামনে দুনিয়ার সমস্ত ভালবাসা ম্লান ও বিলীন হয়ে যায়। আল্লাহ তা'আলা যার অন্তরে আপন হাবীবের ঈদৃশ ভালবাসা জন্ময়েছেন তাঁর জীবন ধন্য; তিনিই পূর্ণ ঈমানের অধিকারী। হে আল্লাহ, আমাদের হৃদয়েও তোমার এবং তোমার হাবীবের এরূপ ভালবাসা জন্মায়ে দাও। আমীন। রাসূল (সাঃ) বলেন- "তোমাদের মধ্য হতে কেউ পূর্ণ ঈমানদার (বলে পরিগণিত) হবে না, যে পর্যন্ত আমি তাঁর নিকট তার পিতা, সন্তান এবং সমস্ত লোক অপেক্ষা অধিক প্রিয় না হই।
যায়দের এহেন অকৃত্রিম ভালোবাসা দেখে রাসূল (সাঃ) সন্তুষ্ট হয়ে তৎক্ষণাৎ তাঁকে দাসত্ব হতে মুক্তি দান করত, পুত্ররূপে গ্রহণ করলেন। এ অভাবনীয় দৃশ্য দর্শন করে যায়দের পিতা ও চাচা যার পর নাই সন্তুষ্ট হয়ে দেশে ফিরে গেলেন। তখন হতেই তিনি যায়দ ইবন মুহাম্মদ বা মুহাম্মদ (সাঃ)-এর পুত্র যায়দ নামেই তিনি প্রসিদ্ধ হলেন। যখন "লোকদেরকে তাদের জন্মদাতা পিতার নামে আহ্বান কর।" আয়াত অবতীর্ণ হল তখন লোকেরা তাঁকে যায়দ বিন হারিসা বা হারিসার পুত্র যায়দ বলে ডাকতে আরম্ভ করল।
ক্রীতদাসকে পুত্ররূপে গ্রহণ করা তখনকার জগতে এক অভাবনীয় কাও ছিল। কোথায় উপেক্ষিত ও ঘৃণিত ক্রীত দাস, আর কোথায় সৃষ্ট-সেরা মহামানবের পুত্র। জাহান্নাম হতে একেবারে জান্নাতে উন্নয়ন। কিন্তু যিনি বিশ্বমানবের মুক্তিদাতা, যিনি আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকেও প্রভু বলে স্বীকার করেন না। ছোট বড় সব মানুষই যাঁর নিকট ভাই ভাই, ক্রীতদাসকে পুত্ররূপে গ্রহণ করা তাঁর জন্য কিছুই অস্বাভাবিক নয়।
পরবর্তীকালে এ যায়দই বিরাট সেনাবাহিনীর সেনাপতি পদে বৃত হয়েছিলেন। রাসূল (সাঃ) তাঁকে যদি এ সুযোগ না দিতেন তবে হয়ত চিরদিনই তিনি লাঞ্ছিত দাসই থেকে যেতেন। এটা ইসলামের বিশেষত্ব। "সমস্ত মুসলমানই ভাই ভাই, তিনি এ বাণী ঘোষণা করে ইসলামের প্রত্যেক মানুষকে স্বীয় প্রতিভা প্রকাশ করার পূর্ণ সুযোগ দান করেছেন। ইসলামের উদারতায় শুধু যে হযরত বিলাল (রাঃ) মুয়াযযিনের পদ এবং কুতুবুদ্দীন ভারতের সিংহাসন লাভ করতে পেরেছিলেন, তাই নয়; বরং আরও বহু দাস-দাসী এবং অস্পৃশ্য বংশোদ্ভূত লোক বিশ্ব বরেণ্য হবার সুযোগ পেয়েছিলেন। তাই কবি বলেন-
ইসলাম ছায়া তলে আসে সব ধেয়ে
লভিতে করুণা তার শান্তি ছায়া পেয়ে।
আবরাহার সৈন্যগণ ধ্বংস হবার পর সমগ্র আরবের সাধারণ ধর্ম-তীর্থ পবিত্র কা'বা গৃহের খাদিম কুরায়শদের আত্মম্ভরিতা অধিক বৃদ্ধি পেল। জনগণ মনে করতে লাগল কুরায়শদের বুযুর্গীর দরুণই আল্লাহ্ তা'আলা হাতীওয়ালা সৈন্যদেরকে ধ্বংস করে দিয়েছেন।
কুরায়শগণ বলতে লাগল আমরা হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর বংশদর এবং আল্লাহর ঘরের খাদিম। সুতরাং আমাদের একটা বিশেষত্ব থাকা উচিত। সর্বসাধারণের মর্যাদা আমাদের সমান হতে পারে না। তারা ঘোষণা করল-
- হজ্জব্রত পালনকালে আমরা সর্বসাধারণের সাথে হারাম শরীফের বাইরে 'আরাফাতের ময়দানে যাব না।
- বাইরের লোকেরা হজ্জ কিংবা 'উমরার ইহরাম বাঁধার পর হারাম শরীফের ভিতরে বাইরে কোন খাদ্য খেতে পারবে না, এখানের তৈরী খাদ্য খেতে হবে।
- বাইরের লোকেরা নিজেদের জাতিগত পোশাক পরিত্যাগ করে কুরায়শদের পোশাক পরিধান করত কা'বা গৃহের তাওয়াফ করতে হবে। কোন কারণ বশতঃ কুরায়শী পোশাক পাওয়া না গেলে উলঙ্গ অবস্থায় তাওয়াফ করতে হবে।
কিন্তু রাসূল (সাঃ) এই ব্যবস্থা পছন্দ করলেন না। তিনি ঘোষণা করতে লাগলেন: সকল মানুষের মর্যাদা সমান। কুরায়শ, অকুরায়শ সকলের একই ব্যবস্থা থাকা উচিত। এই ব্যবস্থার প্রতিবাদস্বরূপ তিনি সর্বসাধারণের সাথে 'আরাফাতের ময়দানে উপস্থিত হতেন।
চল্লিশ বৎসর পরে যখন কুর'আন অবতীর্ণ হল তখন এ সমস্ত কুপ্রথা এবং অসমীচীন ব্যবস্থার উচ্ছেদ হল।
নবুওয়াতের পূর্বে বা পরে তিনি কখনও খেল-তামাশার আসরে উপস্থিত হন নি। এমন কি বাল্যকালেও তাঁর এসব শূয়া ছিল না। বাল্য জীবনে মাত্র দুবার তিনি গল্পের মজলিসে যাবার ইচ্ছা করেছিলেন, কিন্তু যে বালক একদিন নিখিল বিশ্বের আদর্শ ও পদপ্রদর্শক হবেন তাঁর জন্য এটা অশোভন, এজন্য রাহমানুর রাহীম আল্লাহ তা'আলার কুদরতে তিনি রক্ষা পান।
সে কালে 'আরব দেশের লোকদের রূপকথা শোনার খুব আগ্রহ ছিল। অবসর সময়ে রাত্রিকালে এক বাক্তি বসে বসে অদ্ভুত ও বিশ্বয়কর মজার গল্প বর্ণনা করত, আর বহু লোক সমবেত হয়ে তার গল্প শুনত। বাল্যকালে একবার রাসুল (সাঃ) এরূপ মজলিসে যেতে মনস্থ করে বের হলেন, পথে একস্থানে একটি বিবাহ মজলিস ছিল। তিনি তা দেখার জন্য তথায় দাঁড়ানো মাত্রই তিনি আল্লাহর কুদরতে নিদ্রাভিভুত হয়ে পড়লেন। যখন তাঁর চক্ষু খুলল তখন দেখতে পেলেন ডে হয়েছে। আরও একবার এরূপ ইচ্ছা করেছিলেন, তখনও ঠিক এ অবস্থাই হয়েছিল। চল্লিশ বৎসর জীবনের ভিতরে দুবার এরূপ ইচ্ছা করেছিলেন, প্রত্যেক বারই আল্লাহ তা'আলা তাকে রক্ষা করেছেন।
পরিশেষেঃ
প্রিয় পাঠক, আজকের আর্টিকেলের মাধ্যমে আমরা বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর জীবনী সিরিজ পর্বের ৫ম পর্ব শেষ করেছি। এই সিরিজের ৬ষ্ঠ পর্বটি পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
