মহানবী সাঃ এর জীবনী | Mohammad The Final Legacy. Ep-04
আসসালামু আলাইকুম, প্রিয় পাঠক আজকের আর্টিকেল এর মাধ্যমে আমি আপনাদের সাথে শেয়ার করবো মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর সম্পুর্ন জীবনী বাংলা সিরিজ এর ৪র্থ পর্ব সম্পর্কে। আপনি যদি 'মহানবী সাঃ এর সম্পুর্ন জীবনী' এই সিরিজে নতুন হয়ে থাকেন এবং ৩য় পর্বটি পড়তে চান তাহলে এখানে ক্লিক করে আগের পর্বটি পড়ে নিতে পারেন। চলুন আজকের পর্ব শুরু করা যাক-
মহানবী সাঃ এর বিবাহ
মক্কা নগরে কুরায়শ বংশীয় এক সম্ভ্রান্ত মহিলা বাস করতেন। তাঁর নাম ছিল হযরত খাদীজা (রাঃ)। সারা 'আরব দেশে যখন অবলা নারী জাতির দুর্গতির সীমা ছিল না, যেখানে নারীত্বের প্রতি চলতেছিল চরম অবমাননা ও লাঞ্ছনার লীলাখেলা, সেখানে এ সতী সাধ্বী মহিলা স্বীয় পবিত্রতা ও মর্যাদা রক্ষা করে অতি সম্মানের সাথে জীবন যাপন করতেছিলেন। এমন পূণ্যবতী নারী আরবে আর দ্বিতীয়টি ছিল না। তাঁর পবিত্র চরিত্রের সুখ্যাতি 'আরবময় ছড়ায়ে পড়ে। লোকেরা তাঁর পবিত্রতা ও সতীত্বের প্রতি মুগ্ধ হয়ে তাঁকে 'তাহিরা' বা 'পবিত্রা নারী' উপাধিতে ভূষিত করে।
হযরত খাদীজা (রাঃ) যেমন ছিলেন সতী সাধ্বী তেমনই ছিলেন প্রভূত ধন-সম্পত্তির অধিকারিণী। যখন মক্কার বণিকদের কাফেলা বাণিজ্যের জন্য বিদেশ-যাত্রা করত এবং একস্থানে সমবেত হয়ে নিজ নিজ পণ্য দ্রব্য উটের পিঠে বোঝাই করে দিত তখন একা হযরত খাদীজার দ্রব্য সমবেত সমস্ত বণিকদের পণ্যদ্রব্যের সমান হত। এ পূত-পবিত্র ঐশ্বর্যশালিনী মহিলা অতি জ্ঞানবতী ও বুদ্ধিমতী ছিলেন। অতি দক্ষতার সাথে তিনি সংসার পরিচালনা করতেন এবং নিজের ধন-সম্পত্তি রক্ষা করতেন। তিনি কর্মচারী দ্বারা দেশ-বিদেশে বাণিজ্য চালাতেন এবং নিজেই সমস্ত বিষয়ে তত্ত্বাবধান করতেন। তখনকার দিনে এত বড় একটা সংসার রক্ষা করা এবং দেশ-বিদেশে বিরাট একটা ব্যবসা পরিচালনা করা একজন অবলা নারীর জন্য কম গৌরবের কথা নয়।
![]() |
| বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সঃ এর জীবনী। |
কুরায়শ বংশের প্রসিদ্ধ 'কুসায়' ছিলেন হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সাঃ) এবং হযরত খাদীজা (রাঃ)-এর তৃতীয় পিতামহ। সুতরাং এ সম্পর্কে হযরত খাদীজা ছিলেন মুহাম্মদ মুস্তফা (সাঃ) এর চাচাত ভগ্নী।
আল্লাহর কি অগার মহিমা, তাঁর অনন্ত কুদরত যেন এ দুটি অমূল্য রত্বকে দুনিয়ার সমস্ত সৌন্ন। দিয়ে, সমস্ত গুণ-গরিমা দিয়ে জগৎ-পিতা ও জগজ্জননী হবার যোগ্য করে স্বহস্তে গড়ে তুলেছিলেন। রাসূল (সাঃ) যেমন পিতৃ-মাতৃহীন হওয়ার পর পিতামহকে হারিয়ে শোকের পর শোক বরণ করেছিলেন তদ্রূপ হযরত খাদীজাও পিতাকে হারিয়ে এবং স্বামীকে হারিয়ে পুনঃ পুনঃ বিধবা হয়ে শোকের পর শোক বরণ করেছিলেন। হযরত মুহাম্মদ যেমন চরিত্রগুণে সমাজের নিকট 'আমীন' উপাধি লাভ করে ছিলেন, তদ্রূপ হযরত খাদীজা (রাঃ) ও সতীত্ব৬ণে সমাজের নিকট 'তাহিরা' উপাধি লাভকরেছিলেন। এতদুভয়ের মধ্যে এসব সামঞ্জস্য বাস্তবিকই জগতের ইতিহাসে অভিনব। বস্তুতঃ তা যেন ধরাধামে আল্লাহর রহমতের রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্বাভাষ বৈ আর কিছু নয়।
রাসূল (সাঃ)-এর বয়স প্রায় পঁচিশ বছর। তিনি বহু দিন যাবৎ বিভিন্ন গোত্রের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্যে অংশ গ্রহণ করে আসতেছেন, দেশ-বিদেশে যাতায়াত করতেছেন, বহুলোকের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ-পরিচয় হয়েছে। তাঁর গুণ-গরিমার কথা 'আরবময় ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি ত্যাগ, সেবা, সততা ও চরিত্র মাধুর্য দ্বারা সারা আরবের হৃদয়-রাজ্য জয় করে ফেলেছেন। তাঁর জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তা দেখে প্রত্যেক গোত্রের লোকেরাই তাঁকে অতি শ্রদ্ধার চক্ষে দেখেছেন।
অনতিবিলম্বে তাঁর এসব গুণ-গরিমার খবর হযরত খাদীজার কর্ণে পৌছল। বাণিজ্য ক্ষেত্রেও তাঁর অভূতপূর্ব যশকীর্তির কথা শুনে, নিজের বাণিজ্য ভার তাঁর হাতে অর্পণ করার জন্য হযরত খাদীজার মনে এক অদম্য স্পৃহা জেগে উঠল। তিনি আর থাকতে পারলেন না। শীঘ্রই হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-কে ডেকে পাঠালেন।
রাসূল (সাঃ) হযরত খাদীজার বাড়ীতে তশরীফ আনলেন। হযরত খাদীজা সমম্ভ্রমে বলতে লাগলেন, আমি আপনার সত্যনিষ্ঠা, বিশ্বস্ততা ও চরিত্র মহিমার সুখ্যাতি শুনে আপনাকে ডাকতে পাঠিয়েছি। আপনি যদি দয়া করে আমার বাণিজ্য-ভার গ্রহণ করেন তবে আমি যারপর নাই সন্তুষ্ট হব। এটাও পূর্বাহ্নেই জানিয়ে রাখতেছি যে, অন্যান্য ব্যবসায়ীদেরকে আমি যে হারে লভ্যাংশ প্রদান করে থাকি, আপনাকে তার দ্বিগুণ প্রদান করব।
রাসূল (সাঃ) হযরত খাদীজার কথায় সম্মত হলেন। তাঁর চাচা আবু তালিবও হযরত খাদীজার প্রস্তাব শুনে যৎপরোনাস্তি আনন্দিত হলেন। চাচা আবু তালিবের মত নিয়ে তিনি হযরত খাদীজাকে সম্মতি জানিয়েছিলেন।
কাফেলা প্রস্তুত হল। হযরত রাসূল (সাঃ) বাণিজ্যে চললেন। বিবি খাদীজা তাঁর সুযোগ্য ও বিশ্বস্ততম গোলাম মায়সারকে তাঁর সাথে পাঠালেন এবং প্রত্যেক বিষয়ে রাসূল (সাঃ)-এর আনুগত্য করতে মায়সারাকে সবিশেষ তাকীদৃ করে দিলেন। বিবি খাদীজার ভারপ্রাপ্ত বাণিজ্য-নায়করূপে এবার রাসূল (সাঃ) প্রভৃত মূলধনের অধিকারী হয়ে স্বাধীনভাবে ক্রয়-বিক্রয় করার পূর্ণ সুযোগ লাভ করলেন। সুতরাং তিনি এবার স্বীয় অন্তর্নিহিত শক্তি ও গুণাবলীকে কাজে লাগাবার পূর্ণ সুযোগ পেলেন। কাফেলা সিরিয়া যাত্রা করল। বুসরা নগরে পৌঁছিয়ে রাসূল (সাঃ) পণ্যদ্রব্য বিক্রয় করলেন। ব্যবসায়ে প্রচুর লাভবান হয়ে তিনি সবিশেষ আনন্দ ও আত্মপ্রত্যয় উপভোগ করলেন।
রাসূল (সাঃ) বুসরা হতে প্রত্যাবর্তন করে সমস্ত হিসাবপত্র ও টাকা-কড়ি বুঝায়ে দিলেন। প্রচুর লাভ হয়েছে দেখে খাদীজা তাঁর প্রতি অত্যন্ত সন্তুষ্ট হলেন। তাঁর সততা ও বিশ্বস্ততা দেখে তিনি মুগ্ধ হলেন এবং প্রতিশ্রুত পুরস্কার দিয়ে তাঁকে সন্তুষ্ট করলেন।
২৪ প্রথমে হযরত খাদীজার বিবাহ হয়েছিল আবু হালা বিন যারারার সাথে। তাঁর ঔরসে হযরত খাদীজার দুটি পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করে। তাদের নাম যথাক্রমে হিন্দ এবং হারিস। আবু হালার মৃত্যুর পর দ্বিতীয় বার তাঁর বিবাহ হয় 'আতীক বিন 'আয়িযের সাথে। আতীকের ঔরসে বিবি খাদীজার একটি কন্যা জন্ম গ্রহণ করে। কন্যাটির নামও ছিল হিন্দ। অতঃপর তিনি বিধবা অবস্থায় পবিত্র জীবন যাপন করতে থাকেন। লোকের মুখে অনেক দিন হতেই বিবি খাদীজা হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর গুণ গরিমার কথা শুনে আসতেছিলেন। এবার বাণিজ্য উপলক্ষে নিজেও তাঁর অসাধারণ প্রতিভা ও বুদ্ধিমত্তা এবং অনুপম চরিত্র মাধুর্য সম্যকরূপে উপলব্ধি করতে পারলেন। আবার তাঁর বিশ্বস্ত গোলাম মায়সারার মুখেও তাঁর যথেষ্ট যশ-কীর্তি শুনতে পেলেন। এতদ্ব্যতীত রাসূল (সাঃ)-এর ফুফু হযরত সফিয়া ছিলেন বিবি খাদীজার ভাই 'আওয়ামের স্ত্রী। বিবি খাদীজা তাঁর নিকট হতেও সর্বদা রাসূল (সাঃ)-এর সদ্গুণের কথা শুনতে থাকতেন।
দীর্ঘকাল যাবৎ বিবি খাদীজা বিধবা-জীবন যাপন করে আসতেছেন। কোন দিন তাঁর মনে বিবাহের খেয়াল জাগ্রত হয়নি। কিন্তু রাসূল (সাঃ) বুস্না হতে ফিরার তিন মাস পরে বিবি খাদীজার মনে তাঁর সহধর্মিণী হওয়ার আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠল। হযরত খাদীজা নিজ সহচরী এবং উভয় পক্ষের আত্মীয়া নফীসা বিবির দ্বারা রাসূল (সাঃ)-এর নিকট এ পয়গাম পাঠিয়েছিলেন। যখন তাঁর সম্মতি বুঝতে পারলেন তখন তিনি স্বয়ং রাসূল (সাঃ)-এর সাথে বিবাহ সম্পর্কীয় সমস্ত সমস্যার সমাধান করলেন। কারণ সেখানে বিবাহ শাদী সম্পর্কে মেয়েদের পূর্ণ স্বাধীনতা ছিল। তারা নিজেই সব বিষয় মীমাংসা করতে পারত। এজন্যই তাঁর চাচা 'আমর বর্তমান থাকা সত্ত্বেও তিনি নিজেই সব বিষয় মীমাংসা করে ফেললেন। তখন বিবি খাদীজার পিতা খুয়ায়লিদ বিদ্যমান ছিলেন না। ফিজার যুদ্ধের পূর্বেই তাঁর মৃত্যু হয়েছিল।
যথাসময়ে কুরায়শ প্রধানগণ সমভিব্যবহারে উভয় পক্ষের আত্মীয়বর্গ হযরত খাদীজার গৃহে উপস্থিত হলেন। রাসূল (সাঃ)-এর চাচা আবূ তালিব ও হামযা প্রমুখ মুরব্বীগণ বর নিয়ে বিবাহ মজলিসে সমাগত হলেন। হযরত খাদীজার চাচা 'আমর বিন আসাদ এবং তাঁর চাচাত ভাই ওরাকা বিন নওফলও মজলিসে উপস্থিত ছিলেন। এ বিবাহে পাত্রপক্ষে আব্ তালিব এবং পাত্রী পক্ষে 'আমর বিন আসাদ অভিভাকত্ব করলেন। পাত্র পক্ষের অভিভাবক আবূ তালিব বিবাহের খুৎবা পাঠ করলেন।
হযরত খাদীজার চাচাত ভাই ওরাকা বহু শাস্ত্রবিশারদ পণ্ডিত ছিলেন। আবূ তালিবের খুৎবার পর তিনি পাত্রীপক্ষ হতে খুৎবা পাঠ করলেন।
অতঃপর আবূ তালিব বললেন: "খাদীজার চাচা 'আমর এখানে উপস্থিত আছেন। তিনিও যদি বিবাহ প্রদানে আপনার পোষকতা করেন তবে আমরা সবিশেষ কৃতার্থ হব।" তখন 'আমর বললেন, "আপনারা সাক্ষী থাকুন, আমি খুওয়ালিদের কন্যা খাদীজাকে 'আবদুল্লাহর পুত্র মুহাম্মদের সাথে বিবাহ দিলাম।"
'বারাকাল্লাহু লাকুমা'-এর হর্ষ ধ্বনিতে বিবাহ মজলিস মুখরিত হয়ে উঠল। বিপুল উৎসাহ ও আনন্দ কোলাহলের সাথে শুভবিবাহ সম্পন্ন হয়ে গেল।
বিবাহের সময় রাসূল (সাঃ)-এর বয়স ছিল ২৫ বছর আর হযরত খাদীজার বয়স ছিল ৪০ বছর। কি অপূর্ব কাণ্ড! পাত্র পঁচিশ বছরের তরুণ যুবক; রূপে, গুণে এবং বংশমর্যাদায় সারা বিশ্বে যাঁর তুলনা নেই, তিনি বিবাহ করতেছেন চল্লিশ বছর বয়স্কা, ছেলে-মেয়ের মা, বিগত যৌবনা এক বিধবা নারীকে। তিনি কি কোন পরমা সুন্দরী তরুণ বয়স্কা পাত্রীকে বিবাহ করতে পারতেন না? তাঁর জীবনে কি যৌবনের স্বভাব-ধর্ম বিকশি হয় নি। তাঁর তরুণ অন্তরে কি সৌন্দর্য অনুভূতি ছিল না? নিশ্চয়ই ছিল। তবে কেন তিনি এ বিবাহে সম্মতি প্রদান করলেন?
তাঁর অনুভূতি ছিল অত্যন্ত সূক্ষ্ণ। তাঁর দৃষ্টি ছিল অতিশয় গভীর। অস্থায়ী সৌন্দর্য তাঁর কাম্য ছিল না, তিনি ছিলেন চিরস্থায়ী সৌন্দর্যের অনুরাগী। যুবক সুলভ চপলতা তাঁকে লক্ষ্য ভ্রষ্ট করতে পারে নি। যৌবনের ফেনিলোচ্ছ্বাসে তাঁকে বিভ্রান্ত করতে পারে নি। প্রৌঢ়া খাদীজার গতকান্তি দেহের অন্তরালে যে সত্যিকার ধর্মানুরাগ, যে চিরস্থায়ী সৌন্দর্য লুকায়িত ছিল সে সৌন্দর্যের প্রতি মুগ্ধ হয়ে জনসমাজ তাঁকে 'তাহিরা উপাধিতে বিভূষিত করেছিল, মুহাম্মদ (সাঃ) ছিলেন অবিনশ্বর সৌন্দর্যের আসক্ত।
তারুণ্যের কমনীয়তা-যৌবনের সুন্দরতা স্বপ্নলোকের ইন্দ্রপুরীর ন্যায় অতি ক্ষণস্থায়ী।
সুতরাং যাঁদের সুষ্ঠু জ্ঞান আছে, যাঁদের অন্তর্চক্ষু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিসম্পন্ন, তাঁরা এ ক্ষণভঙ্গুর সৌন্দর্যের প্রতি-এ ক্ষণস্থায়ী মনোহারিতার প্রতি অনুরক্ত হতে পারেন না।
পক্ষান্তরে দীনদার, চরিত্রবর্তী, সতী-সাধ্বী স্ত্রী জগতের সর্বোত্তম সম্পদ, ঐহিক ও পারত্রিক সর্ববিধ শান্তির প্রতীক। রাসূল (সাঃ) বলেন-
"সারাটা দুনিয়াই (মানব)-হিতকর সম্পদ, কিন্তু জগতের সর্বোত্তম সম্পদ হল সতী-সাধ্বী রমনী।
"হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূল (সাঃ) বলেন- (সাধারণত) ধন-সম্পদ, বংশ মর্যাদা, রূপ-লাবণ্য এবং ধর্মপরায়ণতা, এই চারটি গুণ দেখে নারীকে বিবাহ করা হয়ে থাকে তুমি ধার্মিকা নারীকে গ্রহণ করে সফলকাম হও, অন্যথায় তোমার কপালে ছাই (অর্থাৎ তুমি মঙ্গল হতে বঞ্চিত থাকবে।)
পাত্রীপক্ষের অভিভাবকগণ কিরূপে পাত্র মনোনায়ন করবে এবং পাত্রের মধ্যে কি কি গুণ থাকলে বিবাহে সম্মতি প্রদান করা উচিত।
রাসূল (সঃ) বলেন "যদি তোমাদের নিকট এমন কোন পাত্র বিবাহের প্রস্তাব করে যার ধর্মপরায়ণতা এবং সচ্চরিত্রতার প্রতি তোমরা সন্তুষ্ট, তবে তোমরা বিবাহে সম্পতি প্রদান কর। অন্যথায় ভূমণ্ডলে মহাগোলযোগ ও বিভ্রাটের সৃষ্টি হবে।
বর্ণিত হাদীসত্রয় হতে প্রতিপন্ন হচ্ছে যে, পাত্র-পাত্রীর যে-সমস্ত গুণের প্রতি লক্ষ্য করে বিবাহে সম্পতি প্রদান করতে হয়, তন্মধ্যে ধর্মপরায়ণতা এবং সচ্চচরিত্রতাই হল সর্বপ্রধান। এ দুটি গুণ বিদ্যমান থাকলে আর অন্য কোন গুণের অপেক্ষা করতে নেই। কারণ, এ দুটি গুণই পার্থিব ও পারলৌকিক শান্তির উৎস। এই গুণদ্বয় থাকা সত্ত্বেও যদি উপযুক্ত পাত্র-পাত্রীর বিবাহে সম্মতি না দেওয়া হয় তবে যে বহু পাপ কর্ম সাধিত হয় এবং ভয়ানক অশান্তি ও মহাবিভ্রাটের সৃষ্টি হয়, তা কারও অবিদিত নয়। রূপ-লাবণ্য, ধন-সম্পদ এবং বংশ মর্যাদার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ধর্ম কর্মে উদাসীন চরিত্রহীন পাত্রে বিবাহ দিলে কিংবা এবংবিধ পাত্রীকে বিবাহ করলে শুধু ধর্ম-জীবনের মাথায় কুঠারাঘাত করা হয় না; বরং পার্থিব জীবনেও সুখী হওয়া সুদূর পরাহত হয়ে দাঁড়ায়। রাসূল (সাঃ)-এর এই মহান আদর্শকে উপেক্ষা করে অনেক মহামনীষীয় জীবনই যে বিপন্ন হয়েছে, তা আমাদের প্রত্যক্ষীকৃত।
অবলা বিধবা দুনিয়ার বুকে যে কত নিঃসহায়। শোকে দুঃখে নানা অভাব অভিযোগে তার জীবন যে কত বিপন্ন। সুখ দুঃখের সাথী, চির জীবনের দরদী সহচর স্বামীকে হাবায়ে আজ সারাটা দুনিয়া তার চক্ষে অন্ধকার। তার মনের বেদনা, অন্তরের দুঃখ প্রকাশের স্থান নেই। তার অন্ন বস্ত্রের সংস্থান, দৈনন্দিন জীবন যাত্রার সামগ্রী সংগ্রহ, তার হাট-বাজার, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি সব কাজের ভার ছিল স্বামীর উপর। কিন্তু এ-সব কাজের সমাধানের জন্য আজ তাকে ধরনা দিতে হয় পরের দ্বারে। নিঃসহায় পেয়ে তার সাথে স্বেচ্ছাচারিতা করতে কেউ কোন সঙ্কোচ মনে করে না। এমন কি তার সবচাইতে প্রিয়বস্তু, প্রাণের ধন সতীত্ব পর্যন্ত আজ বিপন্ন। দুশ্চরিত্র লম্পটের দল তার চরিত্রের উপর আক্রমন করার জন্য সর্বক্ষণ সুযোগ তালাশ করে ফিরতে থাকে।
তদানীন্তন দুনিয়ার কোন সমাজেই নিঃসহায় বিধবার উদ্ধারের কোন ব্যবস্থা ছিল না। 'আরবের অবস্থা ত পূর্বেই বর্ণিত হয়েছে যে, মৃত ব্যক্তির ত্যাজ্য সম্পতিরূপে তার বিধবা পত্নী উত্তরাধিকারীদের অধিকৃত হত এবং তারা তার প্রতি অমানুষিক অত্যাচার করত।
ইয়াহুদী ধর্মে মৃত ব্যক্তির বিধবা স্ত্রী বাধ্যতামুলকভাবে তার ভ্রাতার অধিকৃত স্ত্রীতে পরিণত হত এবং সে যে কোন ব্যবহার করত তা মেনে নিতে বিধবা বাধ্য থাকতে হত। হিন্দু ধর্মেও বিধবার জীবিত থাকার কোন অধিকারই ছিল না। মৃত স্বামীর শ্মাশানের জ্বলন্ত অগ্নিতে ঝাপিয়ে পড়ে সহমরণ বরণ করাই ছিল তার কর্তব। অন্যথায় আজীবন বেশ-ভূষা, সাজ-সজ্জা এবং সর্বপ্রকার প্রষাদন হতে বঞ্চিত থেকে শোকাতুর বেশে জীবন কাটাতে হত।
দুঃখীর দরদী, নিঃসহায়ের সহায়, নিখিল বিশ্বের ত্রাণকর্তা মুহাম্মদ (সাঃ) আবির্ভূত হয়েছেন দুনিয়ার সমস্ত কুপ্রথা, অনাচার অত্যাচারের বিলোপ সাধনের জন্য। তিনি যদি বিধবা বিবাহে সম্পতি প্রদান না করেন তবে এ কুপ্রথা
মূল্যোৎপাটিত হবে কিরূপে? এ লাঞ্ছিত বিধবা সমাজকে উদ্ধার করবে কে?
বাস্তবিক হযরতের প্রাথমিক জীবনের অন্যান্য ঘটনার ন্যায় এ বিবাহের মধ্যেও একটা আসমানী ইঙ্গিত বিদ্যমান আছে।
এ বিবাহও তাঁর পয়গম্বর জীবনের পূর্বাভাস এবং আয়োজন স্বরূপ। পক্ষান্তরে তার নবুওয়াতের বিকাশ ও স্বার্থকতার জন্য হযরত খাদীজার ন্যায় গুণবতী মহীয়সীর সহযোগিতার প্রয়োজনও ছিল। সেই আসমানী ইঙ্গিতেই তিনি অম্লান বদনে প্রৌঢ়া বিধবাকে সাদরে গ্রহণ করেছিলেন।
আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দরবারে তরুণী অপেক্ষা বিধবার মর্যাদা অনেক বেশী। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
"নিজেদের বিধবা নারীদেরকে বিবাহ দিয়ে দাও।"
বিধবার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করা অক্লান্ত ভাবে নামায পড়া, অনবরত রোযা রাখা এবং আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করার সমান
সওয়াব। রাসূল (সাঃ) বলেন:
"যে ব্যক্তি বিধবা এবং গরীবের কার্য সম্পাদনে উদ্যোগী সে ঐ ব্যক্তির ন্যায় যে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করে এবং ঐ ব্যক্তির সমতুল্য যে সারা দিন রোযা রাখে এবং সারা রাত্রি নামায পড়ে।"
রাসূল (সাঃ) দুটি অঙ্গুলি নির্দেশ করে বললেনঃ "রূপ লাবণ্যের অধিকারিণী, মান-মর্যাদাশালিনী যে নারী স্বামীর মৃত্যুতে বিধবা হওয়ার পর নিজের ইয়াতীম শিশুগণ সাবলম্বী না হওয়া পর্যন্ত কিংবা মরে না যাওয়া পর্যন্ত তাদের লালন-পালনের কাজে আবদ্ধ হয়ে (অন্য স্বামী গ্রহণ করা হতে বিরত) থাকে, কিয়ামতের দিন আমি এবং সে নারী এ অঙ্গুলিম্বয়ের ন্যায় নিকটবর্তী হব। (অর্থাৎ সে আমার কাছাকাছি মর্যাদাপ্রাপ্ত হবে)।"
রাসূল (সাঃ) ছিলেন জ্ঞান গরিমায় অদ্বিতীয় মানব। তিনি যতটুকু সংযমী ছিলেন, ভালমন্দ হিতাহিত জ্ঞান তাঁর যতটুকু ছিল, আল্লাহর সৃষ্ট জগতে তার তুলনা নেই। তখন তাঁর বয়সও নিতান্ত কম ছিল না। তিনি ছিলেন পঁচিশ বছরের যুবক। অপর দিকে হযরত খাদীজাও ছিলেন আরবের সর্বশ্রেষ্ঠ বুদ্ধিমতী প্রৌঢ়া নারী। তাঁরও হিতাহিত জ্ঞানের অভাব ছিল না। তাঁর এ বিরাট সংসারের এবং বিষয়-সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনা তিনি নিজেই করতেন। আবার অভিভাবক ছাড়া নিজের বিবাহ নিজে করা তৎকালীন সমাজে কোন দোষের কাজ বলে পরিগণিত হত না। এটা সত্ত্বেও উভয়পক্ষের অভিভাবকদের সম্মতিক্রমে এবং উপস্থিতিতে এ বিবাহ সম্পন্ন হয়েছে। তা মহামানবের মহান আদর্শ। প্রত্যেকেরই এ আদর্শ গ্রহণ করা উচিত।
যৌবন উন্মত্ততার অংশ বিশেষ। বিবাহ সংক্রান্ত ব্যাপারে অনভিজ্ঞ যুবক বা যুবতী প্রাথমিক যৌবনের উম্মাদনায় বিভ্রান্ত হয়ে এমন ভুল করে বসতে পারে, যদ্দরুণ আজীবন তাকে তার প্রায়শ্চিত্ত ভোগ করতে হয়। কিন্তু বিবাহ সংক্রান্ত ব্যাপারে অভিজ্ঞ, স্থিরচিত অভিভাবকগণের এরূপ ভ্রান্তিতে পতিত হওয়ার আশঙ্কা খুবই কম। এজন্য অভিভাবকদের সম্মতিক্রমে বিবাহ করাই বাঞ্ছনীয়।
আজ কাল, পাশ্চাত্যের উলঙ্গ সভ্যতার অনুকরণ করে অনেক যুবক যুবতী অভিভাবকের অমতে বিবাহ করে থাকে। পরিণামে তাদের অনেকেই এর বিষময় ফল ভোগ করতে বাধ্য হয়।
রাসূল (সাঃ) হযরত খাদীজাকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসতেন। হযরত খাদীজা যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিন তিনি দ্বিতীয় বিবাহ করেন নি। পরম তৃপ্তি এবং অতি সন্তোষের ভিতর দিয়েই তাঁদের দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত হয়েছিল। পার্থিব কোন স্বার্থ সিদ্ধির মানসে অথবা অন্য কোন উদ্দেশ্য সাধনের নিমিত্ত এ ভালবাসা ছিল না, বরং নিতান্ত অকৃত্রিম প্রেম ও নিখুঁত ভালবাসার বন্ধনেই এ দুটি হৃদয় নিবন্ধ ছিল। পঁয়ষট্টি বছর বয়সে হযরত খাদীজার মৃত্যু হয়। তখন রাসূল (সাঃ)-এর বয়স পঞ্চাশ বছর। এই সুদীর্ঘ সময়ের ভিতর এক মুহূর্তের তরেও তাঁদের মধ্যে কোন প্রকার মনোমালিন্য উপস্থিত হয় নি।
মহাপুরুষগণ কি অসাধারণ আত্মসংযমী হয়ে থাকেন। তাঁরা সর্বদা কর্তব্য পালনে ব্যস্ত থাকেন। ইন্দ্রিয় সুখ বা ভোগ বিলাসের প্রতি তাঁদের আদৌ লক্ষ্য থাকে না। তাই তিনি পঞ্চাশ বছর বয়স পর্যন্ত এ বৃদ্ধাকে নিয়ে পরিতুষ্ট থাকেন। অন্য কোন বিবাহের কথা তাঁর কল্পনা পথেও পতিত হয় নি। অবশ্য তাঁর মৃত্যুর পর শেষ বয়সে তিনি কর্তব্যের খাতিরে বহু বিবাহ করেছিলেন।
হযরত খাদীজার মৃত্যুতে তিনি ভয়ানক মর্মবেদনা অনুভব করেছিলেন এবং আজীবন হযরত খাদীজার ভালোবাসা ও স্মৃতি তাঁর মানসপটে অঙ্কিত হয়ে রয়েছিল। যখনই কোন প্রাণী যবেহ করতেন তখনই অনুসন্ধান করে হযরত খাদীজার সহচারীদের নিকট উপটোকন স্বরূপ গোশত পাঠাতেন।
হযরত খাদীজার মৃত্যুর পর একবার তাঁর ভগ্নি হালা রাসূল (সাঃ)-এর সাথে সাক্ষাৎ করতে আসেন। তিনি বাইরে দাঁড়িয়ে প্রবেশের অনুমতি চাইলেন। হযরত খাদীজার কণ্ঠস্বরের সাথে তাঁর কণ্ঠস্বরের অনেকটা সামঞ্জস্যতা ছিল। তাঁর কণ্ঠস্বর শ্রবণ মাত্রই হযরত খাদীজার কথা মনে পড়ল, তখন তিনি বিচলিত হয়ে উঠে বললেন, বোধ হয় 'হালা' এসেছে। তথায় হযরত 'আয়িশা (রাঃ) উপস্থিত ছিলেন। মৃত্যু পত্নীর প্রতি স্বামীকে এতটা আকৃষ্ট দেখে তাঁর ভাল লাগল না। সুতরাং তিনি বললেন, "আপনি মৃত বৃদ্ধটির কথা এত স্মরণ করেন কেন? অথচ আল্লাহ্ তা'আলা তদপেক্ষা উত্তম পত্নীসমূহ আপনাকে দান করেছেন।" সহীহ বুখারীতে এ রিওয়ায়তটি এ পর্যন্তই শেষ কিন্তু ইস্ত্রী'আরে আছে, "হযরত 'আয়িশার প্রতিউত্তরে রাসূল (সাঃ) বললেন, 'কস্মিনকালেও নয়, যখন লোকে আমাকে অবিশ্বাস করত তখন খাদীজা আমাকে বিশ্বাস করতেন। যখন সমস্ত মানুষ কাফির ছিল তখন খাদীজা মুসলমান ছিলেন। যখন আমার কোন সহায় ছিল না তখন খাদীজা আমার সাহায্য করতেন।" এস্থলে রাসূল (সাঃ) -এর নিকট আমরা এ উপদেশ পেয়েছি যে, উপকারীর উপকার কখনও ভুলতে নেই। প্রিয়জনের মৃত্যুর পরও তার আত্মীয়-স্বজন এবং বন্ধু বান্ধবদের সাথে সদ্ব্যবহার করা উচিত।
কা'বা শরীফের সংস্কার
পবিত্র কা'বাগৃহ দুনিয়ার সর্বপ্রথম ও সর্বপ্রধান 'ইবাদত-গৃহ। 'অতি প্রাচীন কাল হতেই এ ঘরটি বায়তুল্লাহ বা আল্লার ঘর নামে অভিহিত হয়ে আসতেছে। অন্ধযুগের 'আরবগণ যদিও কুসংস্কারের মোহে পতিত হয়ে এ পবিত্র গৃহে বহু দেবদেবীর বিগ্রহ স্থাপন করেছিল, তথাপি তারা এ-কথা বিশ্বাস করত যে, তা সত্যই আল্লাহর ঘর। কা'বা শরীফ সম্বন্ধে যে এ বিশ্বাস তাদের অন্তরে বদ্ধমূল ছিল, তা একটি প্রসিদ্ধ ঘটনা হতে জানা যায়। তফসীরে বয়ানুল কুর'আন হতে ঘটনাটি উদ্ধৃত হয়েছে।
সেকালে ইয়ামন প্রদেশ হাবশার (আবিসিনিয়ার) খৃষ্টান রাজার অধিকারে ছিল। ইয়ামনে আবরাহা নামক আবিসিনিয়া-রাজ্যের একজন প্রতিনিধি ছিল। আবরাহা এবং তার সহচরগণ সকলেই খৃষ্টান ধর্মাবলম্বী ছিল। আব্রাহা ইয়ামনে একটি গির্জা নির্মাণ করল। তার ইচ্ছা হল, লোকেরা হজ্জের জন্য কা'বায় গমন না করে যেন তার নির্মিত গির্জায় হজ্জ করতে আসে। এ কথার ঘোষণাবাণী রাজ্যময় প্রচারিত হলে আরবের লোকদের বিশেষ করে কুরায়শদের নিকট এ সংবাদ মর্মস্পর্শী বেদনাদায়ক হল। এ ব্যক্তি আবরাহার গির্জাটিতে রাত্রিকালে পায়খানা করে রেখে গেল। মুকাতিল নামক প্রসিদ্ধ টীকাকার বলেন: জনৈক 'আরববাসী উক্ত গীর্জার নিকটে কোন কাজে আগুন জ্বালায়েছিল। কিন্তু হঠাৎ বাতাস সংযোগে গির্জায় আগুন লেগে যায় এবং এ অগ্নিকাণ্ডের ফলে গির্জাটি সম্পূর্ণরূপে জ্বলে যায়। আবরাহা এই সংবাদে ক্রোধান্বিত হয়ে এক বিরাট সেনাবাহিনীসহ কা'বা শরীফ ধ্বংস করত উক্ত কার্যের প্রতিশোধ গ্রহন করার জন্য মক্কাভিমুখে যাত্রা করল। তার সঙ্গে বহু সংখ্যক হাতীও ছিল। আবরাহা তায়িফের পথে 'মাখমাস' নামক স্থানে পৌঁছে মক্কার তদানীন্তন সরদার 'আবদুল মুত্তালিবের নিকট দূত মারফত খবর পাঠাল যে, আমি যুদ্ধ করতে আসি নি, শুধু কা'বা গৃহ বিধ্বস্ত করতে এসেছি। যদি কেউ কা'বা রক্ষার্থ আমাকে প্রতিরোধ করতে অগ্রসর হয় তবে আমি তার সাথে যুদ্ধ করতে বাধ্য হব। 'আবদুল মুত্তালিব সংদ্দিত উত্তরে জানায়ে দিলেন, আমাদের প্রতিরোধের প্রবৃত্তি নেই, যার ঘর তিনিই তা রক্ষা করবেন। তৎপর তিনি আবরাহা কর্তৃক আহূত হয়ে তার নিকট উপস্থিত হয়েও এরূপ কথাবার্তাই বললেন।
আবরাহার নিকট হতে প্রত্যাবর্তন করে 'আবদুল মুত্তালিব সমস্ত কুরায়শসহ পাহাড়ের মধ্যে আত্মগোপন করলেন, যেন আবরাহার সৈন্যগণ তাঁদেরকে কোন প্রকার অত্যাচার করতে না পারে। এদিকে আবরাহার সৈন্যসহ মক্কার দিকে রওয়ানা হল। মুযদালিফার নিকটস্থ 'মুহাস্সর' নামক স্থানে পৌঁছামাত্রই সমুদ্রের দিক হতে একঝাঁক পাখী আসল। পাখীগুলো আকৃতিতে কবুতরের চেয়ে ছোট ছিল, সবুজ ও হলুদ মিশ্রিত রং ছিল। তাঁদের ঠোঁট ও পায়ে মসুর ও ছোলা পরিমাণ ছোট ছোট কঙ্করসমূহ ছিল। সৈন্য দলের উপর পৌছিয়ে পাখীরা তাদের উপর কঙ্করসমূহ নিক্ষেপ করতে লাগল। আল্লাহর কুদরতে কাঁকরগুলো বন্দুকের গুলীর ন্যায় কাজ করতে লাগল, যার উপর একটি কাঁকর পড়ত তারই দফা শেষ। দেখতে দেখতে এলাহী লস্করের আক্রমণে আবরাহা সৈন্য দল নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। অধিকাংশ লোক নিহত হল, কিছু লোক পালায়ে প্রাণ রক্ষা করল। যারা পলায়ন করেছিল তারাও আল্লাহর গযব হতে নিভৃতি লাভ করতে পারে নি। বহু বিপদ ভোগ করার পর শেষ পর্যন্ত তাদের অপমৃত্যু ঘটেছিল।
রাসূল (সাঃ) এর জন্মের পঞ্চাশ দিন পূর্বে এ ঘটনা ঘটেছিল। হযরত জন্মগ্রহণ করেছিলেন রবী'উল আউয়াল মাসের প্রথমাংশ, আর এ ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল মুহাররম মাসের শেষ ভাগে।
হযরত 'আয়িশা (রাঃ) হতে বর্ণিত ছে, তিনি এ দলের বড় মাহুতকে অন্ধাবস্থায় দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করে বেড়াতে দেখেছেন। নওফল বিন আবূ মু'আবিয়া হলেন, তিনি সে নিক্ষিপ্ত কাঁকরগুলো স্বচক্ষে দেখতে পেয়েছেন। এ কিতাবে আছে-কাঁকরগুলো দেহ স্পর্শ করার ফলে কারও কারও শরীরে খুঁজলী-পাঁচড়া দেখা দিয়েছিল, আবার কারও শরীরে গুটি বের হয়েছিল। এ রোগ বৃদ্ধি পাওয়াতেই তাদের জীবনলীলা সাঙ্গ হয়।
আল্লাহ তা'আলা সূরা ফীলে এ ঘটনাই বর্ণনা করেছেন-
“হে মুহাম্মদ (সাঃ), আপনার কি জানা নেই যে, আপনার প্রতিপালক হাতীওয়ালাদের প্রতি কি ব্যবহার করেছেন? তিনি কি (কা'বা ঘর বিনষ্ট করার ব্যাপারে) তাদের প্রচেষ্টাকে আগা-গোড়া বিফল করে দেন নি? আর তিনি তাদের উপর ঝাঁকে ঝাঁকে পাখী পাঠালেন, যারা তাদের উপর কঙ্করজাত পাথরসমূহ নিক্ষেপ করতেছিল। অনন্তর আল্লাহ্ তা'আলা তাদেরকে ভক্ষিত ভূষির মত (নিষ্পেষিত) করে দিয়েছেন।" এমনই ছিল কা'বা ঘরের মাহাত্ম্য।
আল্লাহর ঘরের অবমাননাকারীদের এ দুর্দশা ঘটল। আর যারা আল্লাহর শরী'আতের এবং আহকামের অবমাননা করবে তাদেরও এরূপ শাস্তির ভয় রাখা উচিত। শাস্তি হয়ত দুনিয়াতেও হতে পারে, নতুবা আখিরাতে হওয়া ত একেবারে অনিবার্য।
রাসূল (সাঃ)-এর বয়স যখন পঁয়ত্রিশ বছর তখন কা'বা গৃহের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় হয়ে পড়েছিল। কারণ এ ঘরটি নিম্নভূমিতে অবস্থিত ছিল। বর্ষাকালে সারা শহরের পানি এসে হারাম শরীফে জমা হত। এ পানি প্রতিরোধকল্পে একটি বাঁধ নির্মাণ করে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু বাঁধটি পুনঃপুনঃ ভেঙ্গে যাওয়ায় কা'বা গৃহের দেওয়ালের বিশেষ ক্ষতি সাধিত হয়েছিল। তাছাড়া ঘরটি আজ কালকার 'ঈদগাহের ন্যায় ছাদবিহীন অনুচ্চ প্রাচীর বেষ্টিত ছিল। এসব কারণে কুরায়শগণ বহু দিন হতেই কা'বা গৃহের মেরামতের জল্পনা-কল্পনা করে আসতেছিল। শেষ পর্যন্ত পুরাতন গৃহটি ভেঙ্গে নূতনভাবে সংস্কার করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হল।
ঘটনাক্রমে এ সময়ে জিদ্দা-বন্দরের নিকটে হঠাৎ একটি জাহাজ প্রচণ্ড ঝড়ের ঝাপটায় পতিত হয়ে সমুদ্র উপকূলের সাথে সংঘর্ষ লেগে ভেঙ্গে যায়। এ সংবাদ শুনতে পেয়ে কুরায়শদের মেরামত কার্যের আগ্রহ আরও বেড়ে গেল। তাঁরা কতিপয় লোকসহ ওলীদকে জিদ্দায় প্রেরণ করলেন। ওলীদও তাঁর সঙ্গিগণ জিদ্দায় পৌঁছে ভগ্ন জাহাজের অনেকগুলো কাঠ ক্রয় করে আসলেন। এ কাঠগুলো ছাদ নির্মাণের কাজে ব্যবহৃত হয়েছিল। 'বাকুম' নামক একজন রোমী মিস্ত্রি উক্ত জাহাজের আরোহী ছিল, ওলীদ তাকেও সাথে করে নিয়ে আসছিলেন। এ বাকুমই কা'বাগৃহ সংস্কারে মিস্ত্রির কাজ করেছিল।
কুরায়শ দলপতিগণ বেশ মিলে মিশে সংস্কারের কাজ করতে লাগলেন। কোন গোত্রই যেন এ পুণ্য কর্ম হতে বঞ্চিত না থাকে তজ্জন্য ঘরের এক এক অংশ এক এক গোত্রকে ভাগ করে দেয়া হয়েছিল। প্রত্যেক গোত্রের লোকেরাই দেয়ালের নিজ নিজ অংশ গেঁথে উঠাল। কিন্তু 'হাজরে আসওয়াদ' বা কৃষ্ণ পাথর খানা দেওয়ালের যে-স্থানে সংস্থাপন করতে হবে, সে পর্যন্ত দেয়াল গাঁথা হওয়ার পর হঠাৎ এক মহাবিভ্রাটের সৃষ্টি হল। কোন গোত্রের লোকেরা এ পাথরখানা তার নির্দিষ্ট স্থানে স্থাপন করবে, তা নিয়ে ভয়ানক বিবাদ আরম্ভ হল। কারণ, এর সাথে সামাজিক মান মর্যাদা ও কুলগত শ্রেষ্ঠত্বের সম্বন্ধ ছিল। প্রত্যেক গোত্রেই পাথরটি উঠাইয়ে তার নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠল। তাদের বাক-বিতণ্ডা ও দ্বন্দ্ব-কোলাহলে সারা শহর আতঙ্কিত হয়ে উঠল।
এ কোন্দল-কোলাহলের ভিতর দিয়ে চারটি দিন কেটে গেল। মীমাংসা অসম্ভব মনে করে সকলেই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হল। এমন কি, কোন কোন গোত্র আরবের চিরাচরিত প্রথানুসারে 'রক্তপূর্ণ পাত্রে' হাত ডুবিয়ে মরণ-পণ করল। যুদ্ধ যখন একেবারে অনিবার্য হয়ে উঠল তখন জ্ঞান-বৃদ্ধ আবু উমায়্যা (মতান্তরে তাঁর ভ্রাতা ওলীদ) গুরু গম্ভীর স্বরে বলে উঠলেন: "থাম, থাম, আমার কথা শোন। অকারণে তোমরা কেন রক্তপাত করবে। এ শুভ কর্ম সমাধান তোমরা অশুভের সূত্রপাত করও না। আল্লাহর কাজে আল্লাহর উপর নির্ভর করাই বাঞ্ছনীয়। সুতরাং আমি প্রস্তাব করতেছি, যে ব্যক্তি সর্বপ্রথম এ পরিত্র মসজিদের 'বাবু বনী শায়বা' নামক ফটক দিয়ে প্রবেশ করবে, এ ঝগড়ার মীমাংসার-ভার তার উপর ন্যস্ত করা হোক। সে যে মীমাংসা করবে তাই সকলে শিরোধার্য করে নিবে।" বৃদ্ধের এ প্রস্তাবকে মীমাংসার অতি সুন্দর উপায় মনে করে সকলেই তা মেনে নিল।
তখন সকলেই উদ্বিগ্ন হৃদয়ে উক্ত তোরণের দিকে তাকিয়ে রইল। প্রত্যেকের মনে কত চিন্তার উদ্রেক হতে লাগল। কে জানে কেমন লোক আসবে? কোন পক্ষের লোক, কোন পক্ষে রায় দেয়, তার মীমাংসা যদি সকলের অথবা কোন এক পক্ষের মনঃপুত না হয়, তখন যে কি ঘটনা ঘটে বসে ইত্যাদি ভাবের প্রবল প্রবাহ এবং নানা প্রকার চিন্তার তরঙ্গমালা তাদের অন্তর সমুদ্রে খেলে বেড়াতে লাগল। এমন সময় হঠাৎ সমবেত কণ্ঠে আনন্দধ্বনি উঠল-
"এ যে, আমাদের (প্রিয়) 'আল-আমীন' (সাঃ) আসতেচেন। আমরা সকলেই তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট।"
রাসূল (সাঃ) তখন তরুণ যুবকমাত্র। কিন্তু তবুও তাঁর প্রতি সর্বসাধারণের কি অগাধ বিশ্বাস। কি অতুল ভক্তি।
রাসূল (সাঃ) তথায় আগমন করলে সমস্ত ব্যাপার তাঁকে বুঝায়ে বলা হল। তখন তিনি বললেন: "যে সকল গোত্র পবিত্র হাজরে আসওয়াদ স্থাপন করার অধিকারী বলে দাবী করতেছেন, তাঁরা নিজ নিজ গোত্র হতে এক একজন প্রতিনিধি নির্বাচিত করুন।" ঠিক তাই করা হল। তখন রাসূল (সাঃ) একখানি চাদর বিছায়ে প্রস্তরখানি তার মধ্যস্থলে রাখলেন। তৎপর তিনি প্রতিনিধিগণকে বললেন: "আপনারা আসুন, প্রত্যেকেই এ চাদরের এক এক প্রান্ত ধরে পাথরখানা উঠায়ে নিয়ে চলুন।" এরুপে তাঁরা সকলে মিলে পাথরখানা যথাস্থানে নিয়ে গেলে রাসূল (সাঃ) স্বহস্তে পাথরখানা চাদর হতে উঠায়ে অবধারিত স্থানে তা স্থাপন করলেন। রাসূল (সাঃ)-এর এ মীমাংসায় সকলেই সন্তুষ্ট হলেন। তাঁর বিচক্ষণতার ফলে একটা আসন্ন সমরানল মুহূর্তে নির্বাপিত হয়ে গেল।
হাজরে আসওয়াদ বা কৃষ্ণ প্রস্তরখানা ইসলামের পবিত্র বস্তু। তা আদি পিতা হযরত আদম (আঃ)-এর স্পর্শ, হযরত ইব্রাহীম ও বহু মহাপুরুষের স্পর্শ এবং যুগ যুগান্তরের মূর্তিমান ইতিহাস বক্ষে ধারণ করে রয়েছে। সুতরাং আল্লাহর ঘরের নব প্রতিষ্ঠার দিনে আল্লাহর প্রিয় হাবীব হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর হাতে উক্ত প্রস্তরখানা স্থাপিত হওয়াই ছিল সমীচীন। সুতরাং আল্লাহ তা'আলা তার ব্যবস্থাও করে দিলেন।
গোত্রসমূহের পরস্পর দ্বন্দ্ব মীমাংসার জন্য আবূ উমায়্যার অনির্দিষ্ট সালিস নির্বাচন এবং অপ্রত্যাশিতভাবে 'বাবুস্ সালাম' তোরণপথে রাসূল (সাঃ)-এর আগমন, এসব কিছু যেন কুদরতের অদৃশ্য করাঙ্গুলির ইঙ্গিতে সাধিত হল। সত্য ধর্মরূপ প্রাসাদের শেষ ইষ্টকখানিও যে তাঁর হাতেই স্থাপিত হবে এবং তিনিই যে শেষনবীরূপে আবির্ভূত হয়ে ইসলামরূপে ভিত্তি-প্রস্তুর স্থাপন করত বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সমস্ত বিরোধের অবসান ঘটাবেন, এ ক্ষুদ্র ঘটনার মধ্য দিয়ে যেন সে মহাসত্যের জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত ফুটে উঠেছে।
এ সংস্কার-কার্য সমাধার জন্য কুরায়শ দলপতিগণ সমবেত হয়ে চাঁদা সংগ্রহের ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু এ পূর্ণাকর্মে কেউ যেন অসদুপায়ে উপার্জিত অপবিত্র অর্থ না দিতে পারে, তার পূর্ণ ব্যবস্থা অবলম্বন করেছিলেন। এজন্য সংগৃহীত অর্থের পরিমাণ কম হয়ে পড়ল। পূর্ণ গৃহ নির্মাণের জন্য এ অর্থ যথেষ্ট হবে না ভেবে তাঁরা পূর্ব ভিত্তির কিয়দংশ বাদ দিয়ে অবশিষ্টাংশের উপর ঘরখানা নির্মাণ করলেন। ভবিষ্যতে সুযোগ হলে যেন কা'বা গৃহের অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া যায়, তজ্জন্য তাঁরা বাদ দেয়া অংশটিকে প্রাচীর বেষ্টিত করে রাখলেন। তা বর্তমানে 'হাতীমে কা 'বা' নামে প্রসিদ্ধ।
তৎপর যখন ইয়াযীদের সৈন্যগণ হযরত 'আবদুল্লাহ বিন যুবায়র (রাঃ)-কে মক্কা নগরে অবরোধ করে তখন মিনজানীক যন্ত্রের সাহায্যে ভারি ভারি পাথর নিক্ষেপ করার ফলে কা'বা গৃহের বিশেষ ক্ষতি সাধিত হয়। রাসূল (সাঃ) যে কা'বা গৃহ পুনঃ নির্মানের ইচ্ছা করেছিলেন, সে কথাও 'আবদুল্লাহ্ ইবন যুবায়র, (রাঃ) তাঁর খালা উন্মুল মু'মিনীন হযরত 'আয়িশা (রাঃ)-এর নিকট শুনতে পেয়েছিলেন। এজন্য তিনি তাঁর খিলাফতকালে ঘরটি ভেঙ্গে 'হাতীমে কা'বা (কুরায়শদের বাদ দেওয়া অংশ) তার অন্তর্ভুক্ত করত ইব্রাহীমী ভিত্তির উপর নূতন করে নির্মাণ করেন এবং হজ্জযাত্রীদের যিয়ারতের সুবিধার জন্য এদিকে আরও একটি দরজা খুলেন। কিন্তু তিনি যখন 'আবদুল মালিক ইবন মারওয়ানের সেনাপতি হাজ্জাজ কর্তৃক শহীদ হন তখন হাজ্জাজ 'আবদুল মালিকের সঙ্গে পরামর্শ করে 'আবদুল্লাহ্ ইবন যুবায়রের নির্মিত ঘরখানা ভেঙ্গে আবার কুরায়শদের ন্যায় হাতীমে কা'বা বাইরে রেখে নূতনভাবে নির্মাণ করেন। পরে যখন 'আবদুল মালিক হযরত আ'য়েশা (রাঃ)-এর বর্ণিত হাদীসটি শুনতে পেলেন তখন তিনি বিশেষ অনুতপ্ত হন এবং হাজ্জাজকে বদ দু'আ করেন।
হাজ্জাজের নির্মিত কা'বা গৃহই অদ্যাবধি বিদ্যমান আছে। পরবর্তীকালে খলীফা হারুনুর রশীদ হাজ্জাজের নির্মিত ঘরটি ভেঙ্গে রাসূল (সাঃ)-এর আকাঙ্ক্ষিত রূপে 'আবদুল্লাহ বিন যুবায়ের ন্যায় নূতনভাবে নির্মাণের ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু 'আব্দুল মালিক তাঁকে বাধা দিয়ে বললেন: এরূপ করলে আল্লাহর ঘর বাদশাহদের একটি ক্রীড়নকে পরিণত হয়ে পড়বে। কারণ, পরবর্তী বাদশাগণও হয়ত ভেঙ্গে ভেঙ্গে নূতন নূতন ফ্যাশনে নির্মাণ করার প্রয়াস পাবেন। এতে পবিত্র বায়তুল্লাহর মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হবে। এ কথা শুনে তিনি এ সংকল্প পরিত্যাগ করলেন। তৎপর অদ্যাবধি আর কেউ এরূপ করার সংকল্প করেন নি।
রাসূল (সাঃ) কা'বা গৃহ নির্মাণকালে কুরায়শদের সাথে স্বয়ং পাথর কাঁধে করে আনতেন। এমন কি, প্রস্তরের ঘর্ষণে তাঁর স্কন্ধ মুবারকের ত্বক উঠে গিয়েছিল।
রাসূল (সাঃ) মসজিদে হারামের 'বাবুস্ সালাম' নামক তোরণ-পথে আগমন করেন। সকল গোত্রের লোকেরাই অতীব আনন্দিত হয়ে তাঁর সালিসী শিরোধার্য করে নিলেন। এমতাবস্থায় অন্য কাউকেও অধিকার না দিয়ে তিনি যদি একাই এ পবিত্র পাথরখানা উঠাবার মর্যাদা গ্রহণ করতেন কিংবা নিজ গোত্র বনু হাশিমকে এ সম্মানজনক কাজের পূর্ণ অধিকার দান করতেন তবে তাতে কারও অসম্মত হওয়ার বা কোন প্রকার অসন্তুষ্ট হওয়ার কোন অধিকার ছিল না। এতদসত্ত্বেও তিনি নিজের স্বার্থে জলাঞ্জলি দিয়ে সর্বসাধারণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করার পূর্ণ সুযোগ দান করলেন।
বাল্যকালেই তিনি সর্বসাধারণের নিকট 'সাদিক' বা 'সত্যবাদী' উপাধি প্রাপ্ত হয়েছিলেন। আবার যৌবনের প্রারম্ভেই সারা আরবের লোকেরা তাঁকে 'আল্-আমীন' বা 'বিশ্বস্ত' উপাধি দান করেন। তৎপর 'হাজরে আসওয়াদ' সম্পর্কীয় বিবাদ মীমাংসার সময় সকল গোত্রের আবালবৃদ্ধ সমবেতভাবে তাঁর নেতৃত্বের প্রতি আনন্দ প্রকাশ করেন। তা হতে প্রতিপন্ন হচ্ছে যে, সে সময় তিনি সারা 'আরবে নেতৃত্বের শীর্ষস্থান অধিকার করেছিলেন। কিন্তু এতবড় মর্যাদার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও তিনি সর্বসাধারণের সাথে কাঁধে করে পাথরের বোঝা আনতে কোন প্রকার লজ্জা বা অপমান বোধ করেন নি।
সৃষ্ট-সেরা আদর্শ মানবের এ সমস্ত কার্যকলাপ হতে বর্তমান যুগের শাসনকর্তা, উচ্চ পদস্থ কর্মচারী, সমাজের নেতৃবৃন্দ এবং অন্যান্য বড় লোকদের উপদেশ গ্রহণ করা উচিত।
নওমুসলিমদের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হতে পারে, এ আশঙ্কায় একান্ত ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও রাসূল (সাঃ) কা'বা গৃহের সংস্কার করেন নি; কিন্তু যখন এ আশঙ্কা রইল না তখন হযরত 'আবদুল্লাহ্ ইবন যুবায়র (রাঃ) রাসূল (সাঃ)-এর অভিলষিত সংস্কার সাধন করলেন। তা হতে প্রতিপন্ন হচ্ছে যে, কোন সত্য প্রচার করতে হলে কিংবা কোন ন্যায় ও কর্তব্য কর্ম সমাধা করতে হলে, এরূপভাবে করা উচিত, যেন সর্বসাধারণের মধ্যে কোন বিভ্রান্তি কিংবা ভুল ধারণার সৃষ্টি হতে না পারে।
পরিশেষেঃ
প্রিয় পাঠক, আজকের আর্টিকেলের মাধ্যমে আমরা বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সঃ এর জীবনী সিরিজ পর্বের ৪র্থ পর্ব শেষ করেছি। এই সিরিজের ৫ম পর্বটি পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন।
