মহানবী সাঃ এর জীবনী । Mohammad: The Final Legacy. Ep-10
আসসালামু আলাইকুম, প্রিয় পাঠক আজকের আর্টিকেল এর মাধ্যমে আমি আপনাদের সাথে শেয়ার করবো মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর সম্পুর্ন জীবনী বাংলা সিরিজ আর্টিকেল এর ১০ম পর্ব সম্পর্কে। আপনি যদি 'মহানবী সাঃ এর সম্পুর্ন জীবনী' এই সিরিজ আর্টিকেলে নতুন হয়ে থাকেন এবং ৯ম পর্বটি পড়তে চান তাহলে এখানে ক্লিক করে আগের পর্বটি পড়ে নিতে পারেন। চলুন আজকের পর্ব শুরু করা যাক-
কালিমা তায়্যিবার অর্থ
মানুষের কাজ প্রধানতঃ দুই প্রকার মানসিক ও শারীরিক। বিশ্বাস, ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা প্রভৃতি মানসিক কাজের অর্ন্তভুক্ত। পঞ্চ ইন্দ্রিয়, হস্ত, পদ প্রভৃতি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ দ্বারা সম্পাদিত কাজগুলো শারীরিক কাজের অন্তর্গত। যেহেতু মানসিক বিশ্বাস, ইচ্ছা প্রভৃতির পরিপ্রেক্ষিত্রেই শারীরিক কাজগুলো সম্পাদিত হয়ে থাকে, এজন্য শারীরিক কাজ মানসিক কাজের অধীন। এজন্যই রাসূল (সাঃ) মানসীক কাজের মধ্যে যে কাজটি সর্বোত্তম এবং মানব-জীবনের সর্ব প্রকার মঙ্গলের উৎস, মানব সমাজকে তা শিক্ষা দেবার জন্য সর্বপ্রথমই ঘোষণা করলেন-
আল্লাহ তা'আলা ব্যতীত আর কেউ 'ইবাদতের যোগ্য নেই। মুহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহর রাসূল।"
![]() |
| মহানবী সাঃ এর আদর্শ জীবন কাহিনী চমকপ্রদ |
মা'বুদ বা 'ইবাদতের যোগ্য হবার জন্য যে সমস্ত গুণের অধিকারী হওয়া আবশ্যক, তা শুধু একমাত্র আল্লাহর মধ্যেই আছে অন্য কারও মধ্যে এসব গুণ নেই। তিনি অদ্বিতীয়, অনাদি, অনন্ত, অভাবহীন, কারও মুখাপেক্ষা নহেন; আর সকলেই তাঁর মুখাপেক্ষা। তিনি সর্বশক্তিমান, যা ইচ্ছা করতে পারেন, তাঁকে বাঁধা দিবার ক্ষমতা কারও নেই। তিনি বিশ্বজগতের সৃষ্টিকর্তা; আবার যখন ইচ্ছা করেন, তখন সব কিছু ফাংস করে দিবেন। মানুষের সুখ দুখ, ভাল-মন্দ, জীবন-মরণ, ঐহিক ও পারত্রিক সর্বপ্রকার, মঙ্গলামঙ্গলের মালিক একমাত্র তিনিই। অতএব 'ইবাদতের যোগ্যও একমাত্র তিনিই।
যেহেতু বাহ্যিক ইন্দ্রিয় বা অন্য কোন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ দ্বারা এই কথাটি বিশ্বাস করা যায় না; বরং এটা বিশ্বাস করতে হয় অন্তর দিয়ে। এজন্যই এটা হল মানুষের মানসিক কাজ। শারীরিক হউক বা মানসিক হউক, মানুষ যত প্রকার কাজ করতে পারে তন্মধ্যে মানব জীবনের সর্বোত্তম কাজই হল উপরিউক্ত কালিমা শরীফের মর্মের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা। কারণ, মানুষ যখন তা বিশ্বাস করবে তখন সে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে সকল মন্দকে বর্জন এবং সকল ভালকে গ্রহণ করতে বাধ্য হয়ে পড়বে। সুতরাং এই কালিমা তায়্যিবাই হল সর্বময় মঙ্গলের মূল উৎস।
'ইবাদত অর্থ দাসত্ব। "আল্লাহ তা'আলাকে ব্যতীত আর কেউ ইবাদতের যোগ্য নয়।" এ কথার অর্থ হল এই-একমাত্র আল্লাহই মানুষের মা'বুদ বা প্রভু। আর মানুষ হল তাঁর দাস। সে যখন অন্তর দিয়ে এই কথা বিশ্বাস করবে যে, আমি আল্লাহর দাস, তখন সে নিজেই চিন্তা করবে যে, দাসের কর্তব্য কি? দাসের কর্তব্য হল, প্রভুর আজ্ঞাবহ হয়ে এবং তাঁর নির্দেশিত সমস্ত কাজ সুন্দরূপে সমাধা করে তাঁকে সন্তুষ্ট করা। সুতরাং আল্লাহর নির্দেশ। পালনের জন্য তাঁর অন্তরে অদম্য প্রেরণা জেগে উঠবে।
আল্লাহ হলেন প্রভু, আর মানুষ হল দাস। প্রভুর সাথে দাসের কোন দিনই সাক্ষাৎ হয় নি। তাঁকে দেখে নি, তাঁর কথাও শুনে নি। কি কাজ করলে যে প্রভু সন্তুষ্ট হবেন, আর কি করলে যে তিনি অসন্তুষ্ট হবেন, তাও সে জানে না। এযে এক মহাসমস্যা। গোলাম এখন করবে কি?
এই সমস্যার সমাধানই হল উক্ত কালিমা তায়্যিবার শেষাংশ- "মুহাম্মদ আল্লাহর প্রেরিত মহাপুরুষ"।
বান্দাদের এই জটিল সমস্যার সমাধানস্বরূপ আল্লাহ তা'আলা মুহাম্মদ মুস্তফা (সাঃ)-কে প্রেরণ করেছিলেন। সুতরাং মুহাম্মদ মুস্তফা (সাঃ) জীবন এবং তাঁর বাণীই হল বান্দাদের একমাত্র আদর্শ। তিনি যা করেন বা করতে বলেন অথবা কাউকেও করতে দেখে নীরব থাকেন, তাই হল আল্লাহর আদিষ্ট বা ভাল কাজ। আর যা হতে বিরত থাকেন বা করতে নিষেধ করেন, তাই হল আল্লাহর নিষিদ্ধ বা মন্দ কাজ। আল্লাহ তা'আলা পবিত্র কুর'আনে বলেন-
"এবং তিনি (মুহাম্মদ সাঃ) প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে কিছুই বলেন না, যা কিছু বলেন তা আল্লাহর প্রেরিত ওহী ব্যতীত আর কিছুই নয়। আল্লাহ তা'আলা অন্যত্র বলেন-
"এবং তোমাদের জন্য রাসূল (সাঃ)-এর মধ্যে মহান আদর্শ নিহিত আছে।"
তিনি আরও বলেন-
"(হে মুহাম্মদ আপনি বলে দিন, যদি তোমরা আল্লাহর সাথে ভালবাসা স্থাপন করতে চাও তবে তোমরা আমার অনুসরণ কর, তবেই আল্লাহ তা'আলা তোমাদেরকে ভাল বাসবেন।"
মোটকথা মুহাম্মদ (সাঃ)-কে আদর্শরূপে গ্রহণ করলে এবং তাঁর অনুসরণ করে চললেই দাসত্বের কর্তব্য পালন করা হবে, মন্দকে বর্জন ও ভালোকে গ্রহণ করা হবে এবং আল্লাহর প্রিয়পাত্র হতে পারা যাবে। এটার নাম কৃতকার্যতা এরই নাম সফলতা। মানুষ যখন আল্লাহর প্রিয় পাত্র হবার মর্যাদা লাভ করতে সক্ষম হয় তখন তার আর কোন কিছুরই অভাব থাকে না। তার ঐহিক ও পারত্রিক সর্বপ্রকার মঙ্গলই সাধিত হয়।
মানুষ যখন কালিমা তায়্যিবার স্বীকারোক্তি করে, তার মর্মের প্রতি ভক্তিপূর্ণ আন্তরিক বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তার মর্মানুসারে রাসূল (সাঃ)-কে আদর্শরূপে গ্রহণ করে নিজের জীবনকে তাঁর জীবনের ছাঁচে গড়ে তুলতে পারে, তখনই সে ফেরেশতাদের চেয়ে উচ্চ মর্যাদার অধিকারী হয়। এরূপ লোককেই 'কামিল মু'মিন' বা পূর্ণ বিশ্বাসী বলা হয়। অন্যথায় তার পতন হয় এবং অপরাধী বা বিদ্রোহীর অর্ন্তভুক্ত হয়ে পশু অপেক্ষা হীনাবস্থা প্রাপ্ত হয়।
কুফরের প্রকারভেদ
যে ব্যক্তি কালিমা তায়্যিবাকে অস্বীকার করবে, অস্বীকৃতির তারতম্যানুসারে তার কয়েকটি অবস্থা হতে পারে:
১. মৌখিক স্বীকারোক্তিও করে না, 'কালিমা'-এর মর্মের প্রতি আন্তরিক বিশ্বাসও নেই, তদনুসারে কার্যানুষ্ঠান কর্তব্য বলেও মনে করে না। এই অবস্থায় সে আল্লাহর প্রকাশ্য বিদ্রোহী বা কাফির। যার অন্তরে অনিচ্ছাসত্ত্বেও স্বতঃই 'কালিমা তায়্যিবা'-এর মর্মের প্রতি বিশ্বাস জন্মে উঠে; কিন্তু সে তা মানে না, এমন ব্যক্তিও এই পর্যায়েরই অন্তর্ভুক্ত।
২. মৌখিক স্বীকারোক্তি করে না; কিন্তু 'কালিমা'-এর মর্মের প্রতি আন্তরিক বিশ্বাস রাখে, তদনুযায়ী অনুষ্ঠানাদিও পালন করে। এই অবস্থায় সে মু'মিন বা বিশ্বাসী বান্দা; কিন্তু যেহেতু মানুষ তার অন্তরের খোঁজ জানতে অক্ষম, এজন্য পার্থিব বিধানে সে অবিশ্বাসী বা কাফির বলে পরিগণিত হবে।
৩. মৌখিকভাবে স্বীকার করে; কিন্তু 'কালিমা'-এর মর্মের প্রতি বিশ্বাস নেই। এই অবস্থায় সে পার্থিব বিধানে মুসলমান বলে পরিগণিত হবে। কিন্তু বস্তুতঃ সে আল্লাহর নিকট বিদ্রোহী কাফিরেরই অর্ন্তভূক্ত থাকবে। এরূপ কাফিরকে মুনাফিক বা কপট বলা হয়।
৪. মৌখিক ভাবেও স্বীকার করে না, আন্তরিক বিশ্বাসও নেই। কিন্তু অন্যান্য বহু পুণ্যকর্ম সমাধা করে থাকে। এই অবস্থায়ও সে বিদ্রোহী কাফির। তার সমস্ত পুণ্য কর্ম পণ্ড হয়ে যাবে; পরকালে এর প্রতিদান পাবে না। কারণ, বিদ্রোহ পরিত্যাগ না করা পর্যন্ত রাজার নিকট বিদ্রোহী প্রজার কোন সৎকাজেরই মূল্য হতে পারে না এবং তার প্রতিদানও পেতে পারে না
৫. 'কালিমা'-এর প্রথমাংশকে মৌখিকভাবেও স্বীকার করে এবং এর মর্মের প্রতিও বিশ্বাস রাখে, কিন্তু মুহাম্মদ (সাঃ)-কে আল্লাহর রাসূল বলে বিশ্বাস করে না। এই অবস্থায়ও সে প্রকাশ বিদ্রোহী কাফির। কারণ, রাজদূতকে অমান্য করলে প্রাকান্তরে রাজাকেই অমান্য করা হয়। যে সমস্ত অবস্থায় মানুষ মু'মিন বা বিশ্বাসী থাকে সেই সমস্ত অবস্থায় যদি ধর্মানুষ্ঠানে তার কোন প্রকার ত্রুটিবিচ্যুতি ঘটে তবে আল্লাহ তা'য়ালা অনুগ্রহ করে তাকে তা ক্ষমাও করতে পারেন। নতুবা পরকালে কৃত অপরাধের শাস্তি ভোগ করার পর সে উদ্ধার পাবে এবং তার প্রত্যেক পুণ্য কর্মের প্রতিফল লাভ করবে।
আর যে সমস্ত অবস্থায় যে কাফির বা অবিশ্বাসীর অন্তর্ভুক্ত থাকবে, সে সমস্ত অবস্থায় বিদ্রোহী হওয়ার দরুন তার সমস্ত পূণ্যকর্ম পণ্ড হয়ে যাবে এবং অনন্তকাল সে কঠোর শাস্তি ভোগ করতে থাকবে।
সত্যের বিরুদ্ধাচরণ
যখন কোন মহাপুরুষ সত্য নিয়ে এই ধরাধামে আগমন করেছেন তখনই তাঁর দেশবাসিগণ এবং তাঁর বংশধরগণ তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করেছে। এজন্যই ত প্রথম দিনই ওরাকা ইবন নওফল বলেছেন, "হে মুহাম্মদ (সাঃ), যেদিন আপনার দেশবাসী আপনার সাথে শত্রুতা করবে, সেদিন যদি আমি বেঁচে থাকতাম, তবে আপনাকে আমার প্রাণ দিয়ে এবং আমার সর্বশক্তি ব্যয় করে সাহায্য করতাম।"
যারা বিরুদ্ধাচরণ করে তারা নিজেদের কার্যকলাপের যৌক্তিকতা প্রতিদান করার জন্য কোন একটা কারণ প্রদর্শন করে থাকে। বস্তুতঃ তা কারণ নয়, বরং মূর্খ গোঁড়া লোকদেরকে উত্তেজিত করার জন্য একটা ছলনা মাত্র। প্রকৃত কথা হল এই যে, সত্যকে নামিয়ে নিলে নিজেদের স্বার্থ নষ্ট হয়, আভিজাত্যের প্রতি আঘাত পড়ে প্রভাব-প্রতিপত্তি নষ্ট হয়।
কুরায়শের বিরুদ্ধাচরণের কারণ
১. সারা আরবের পৌত্তলিকগণ পবিত্র কা'বা গৃহকে তাদের সাধারণ দেব-মন্দির বলে বিশ্বাস করত। তারা তিনশত, ষাটটি দেবমূর্তি এই গৃহে স্থাপন করে পূজা করত। তন্নধ্যে হুবল নামক দেবতাটি ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ। এটাকে তারা ভাল ও মন্দের বিধাতা বলে বিশ্বাস করত। তাদের ধারণা ছিল যে, বৃষ্টি বর্ষণ, সন্তানাদি দান, যুদ্ধে জয়লাভ ইত্যাদি সব বড় বড় কাজগুলো হুবল দেবতা কর্তৃকই সাধিত হয়ে থাকে। কুরায়শগণ ছিল কাবা গৃহের সেবায়েত এবং পূজা-অর্চনার পুরোহিত। এজন্য সারা আরবে তাদের অতি বড় মর্যাদা ছিল। এই দেব-দেবীর কল্যাণেই তারা সারা আরবে রাজা বা শাসনকর্তার সমমর্যাদা লাভ করেছিল।
অপরদিকে হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সাঃ) প্রচার করতেছেন, যে এই দেবতা মানুষের হাতে গড়া পাষাণ-বিগ্রহ। একটি মাছির যে ক্ষমতা তাদের এই ক্ষমতাও নেই। এরা আবার অন্যের উপর বা অপকার করবে কিরূপে? এদের পূজ্য করা নিরেট মূর্খতা এবং বোকামী বৈ আর কিছুই নয়। তিনি আরও বলেন, কৌলিন্য, পৌরোহিত্য প্রভৃতির কারনে মানুষের মর্যাদা বাড়তে পারে না। সকল মানুষই হযরত আদমের সন্তান, সকলেই আল্লাহর বান্দা। সুতরাং সকলের মর্যাদাই সমান। ধর্মশাস্ত্রে, ধর্মানুষ্ঠানে দাস-প্রভু, রাজা-ভিখারী, ধনী-দারিদ্র, ছোট-বড় সকলের সমান অধিকার। যে ব্যক্তি সব চেয়ে বেশী দীনদ্বার, পরহেযগার আল্লাহভীরু সে-ই সর্বাপেক্ষা মর্যাদাশালী।
যুগ যুগান্তর ধরে যে জাতি মূর্তি পূজা করে আসতেছে, যাদের অস্থিমজ্জায় পৌত্তলিকতা প্রবেশ করেছে, যাদের অন্তরাত্মা বংশগৌরব ও পৌরোহিত্য-মর্যাদার অহংকারে পরিপূর্ণ হয়ে রয়েছে। আকস্মাৎ এসব ঘোষণা শুনে তাদের শরীরে আগুন লেগে গেল। তারা ভাবল-মুহাম্মদ (সাঃ) যদি সত্য প্রচারে কৃতকার্য হন তবে আমাদের চির পূজিত দেবতাসমূহের ত সর্বনাশ হবেই, তৎসঙ্গে আমাদের প্রভাব-প্রতিপত্তির সমাপ্তি ঘটবে। এজন্যই তারা রাসুলের বিরুদ্ধে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল।
২. কুরায়শদের ধারণা ছিল, যারা প্রভাব-প্রতিপত্তিশীল সরদার, যারা ধনে-জনে সমাজসেরা, একমাত্র তারাই বড় বড় পদে অধিকারী হতে পারে। নবুওয়ত তো ছোট খাট পদ নয়, এত অতি উচ্চ মর্যাদাপূর্ণ পদ। সুতরাং কোন বড় সরদারকে এই পদ দান করা উচিৎ ছিল। কুরআন মজীদে আছে-
"এবং তারা বলে যে, এই কুরআন কেন অবতীর্ণ হল না (মক্কা ও তায়িফ এই) দুই জনপদের কোন একজন প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তির উপর।"।
এই সময় নিম্নলিখত ব্যক্তিগণ কুরায়শ বংশের উচ্চপদস্থ সরদার ছিল।
১. ওলীদ ইবন মুগীরা: কুরায়শের সর্বশ্রেষ্ঠ সরদার হরব বিন উমাইয়ার মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র আবূ সুফইয়ান শাসনভার গ্রহণের অনুপযুক্ত ছিল। এজনা ওলীদ স্বীয় প্রতিভা বলে এই পদ লাভ করে।
২. আবু জাহল: সে উল্লিখিত ওলীদের ভ্রাতুপুত্র ছিল। কুরায়শদের মধ্যে তাও বিশেষ প্রতিপত্তি ছিল।
৩. আবু সুফইয়ান: ইনি যদিও স্বীয় পিতার পদ লাভ করতে পারেন নি, তথাপি নিজ গোত্র উমাইয়া বংশের সরদার ছিলেন।
৪. আবু লহব: সে রাসূল (সঃ)-এর চাচা ছিল এবং হাশিম বংশের সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ ছিল।
৫. ওয়ায়িলের পুত্র 'আস: সে অনেক সন্তানের পিতা এবং বহু ধন-সম্পত্তির অধিকারী ছিল। এই পাঁচ জনই ছিল প্রধান সরদার। আবু মদ সকফী মুত্তালিবের পুত্র আসওয়াদ, 'আবদে য়্যাগুসের পুত্র আসওয়াদ, নযর বিন হরস, খালফের পুত্র উমাইয়া, 'উবা প্রমুখ উক্ত পাঁচ জনের অধীনস্থ সরদার ছিল।
এজন্যই ইসলামের বিরুদ্ধাচরণে এবং মুসলমানদের প্রতি অত্যাচার ও উৎপীড়নের বর্ণনাতে বিশেষভাবে তাদের নামই দেখতে পাওয়া যায়।
৩. কুরায়শদের মধ্যে বনু হাশিম ও বনু উমাইয়া গোত্র বিশেষ শক্তিশালী ছিল। অনেক পূর্বকাল হতেই এই গোত্রদ্বয়ের মধ্যে নেতৃত্ব ও প্রতিপত্তি নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলে আসতেছিল। পরবর্তীকালে বনু হাশিমই বনু 'আব্বাস নামে প্রসিদ্ধি লাভকরেছিল। এমনকি পরবর্তীকালে এই দুই দলের মধ্যে দীর্ঘ কাল যাবত খিলাফত নিয়ে ভীষণ কলহ চলছিল। 'আব্বাসী ও উমাইয়া বংশীয় খলীফাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা কারও অবিদিত নয়।
হাশিম বংশে 'আবদুল মুত্তালিব ছিলেন অতি শক্তিশালী সরদার। তিনি যত দিন জীবিত ছিলেন ততদিন পর্যন্ত উমাইয়াগণ মাথা উঁচু করতে সাহস পায় নি। তাঁর মৃত্যুর পর হাশিম বংশে কোন প্রতিভাশালী লোক না থাকায় উমাইয়াগণ ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠে। এই সময়েই হাশিম বংশে রাসূল (সঃ)-এর আবির্ভাব হয়। সুতরাং উমায়্যাগণ মনে করত যে, তাঁর নবুওয়ত স্বীকার করলেই আমরা হাশীমবংশের নিকট পরাস্ত হয়ে পড়ব। এজন্য তারা রাসূল (সঃ)-এর বিরুদ্ধাচরণ করেছে সবচাইতে বেশী। বদর ব্যতীত অন্যান্য প্রায় সবগুলো যুদ্ধই সংঘটিত হয়েছিল উমাইয়া সরদার আবু সুফইয়ানের প্ররোচনায়।
হরব ইবন উমাইয়ার মৃত্যুর পর মখযুম বংশের 'ওলীদ' কুরাংশের শাসনকর্তা পদ অধিকার করেছিল। এজন্য মখযুমীগণও তখন বেশ ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেছিল। নিজের ক্ষমতা বজায় রাখার জন্য তারাও আদা-জল খেয়ে রাসূল (সঃ)-এর সাথে শত্রুতা করত এ কথা স্বয়ং আবু জাহল ও স্বীকার করেছে।
এবার আখনাস ইবন শরীক নামক এক ব্যক্তি আবু জাহলকে জিজ্ঞেস করল যে মুহাম্মদ (সঃ) সম্বন্ধে তোমাদের মত কি? তখন আবু জাহল উত্তর করল যে, আমরা মখযূম গোত্রের লোক বনু 'আবদে মানাফ (হাশিম গোত্র) কোন দিক দিয়েই
আমাদের চেয়ে উচ্চ মর্যাদার অধিকারী নয়। অতিথি সেবায়, বীরত্বে, দানশীলতা সব দিক দিয়েই আমরা তাদের সমকক্ষ এখন তারা নবুওয়তের দাবি করতেছে। আল্লাহর কসম, আমরা কখনও এই পয়গম্বরের উপর ঈমান আনব না।
৪. সারা 'আরব তখন নানা পাপে লিপ্ত ছিল। জুয়া খেলা, সুদ গ্রহণ, লুণ্ঠন, অপহরণ, ব্যভিচার, দাস দাসীর প্রতি পাশর অত্যাচার প্রভৃতি তখন আরবের নিত্য নৈমিত্তিক কাজ, এমনকি ধর্ম ও কর্তব্যের মধ্যে পরিগণিত ছিল। সর্বসাধারণের ত কোন কথাই নেই; সম্ভ্রান্ত বংশের নামজাদা সরদারগণের চরিত্রও নানা কলঙ্কে কলুষিত ছিল। হাশিম বংশের প্রসিদ্ধ সরকার আবূ লহব কা'বা শরীফের ধনাগার হতে সোনার হরিণ চুরি করে বিক্রি করেছিল। আখনস বিন শরীফ 'আরবের সরদারদের অন্যতম। সে মিথ্যা কথা বলে দুই বন্ধুর মধ্যে ঝগড়া লাগাতে বিশেষ সিদ্ধহস্ত ছিল। নযর ইবন হারিসও কুরায়শের প্রসিদ্ধ সরদার ছিল। সে প্রায়ই মিথ্যা কথা বলত।
রাসূল্লাহ (সঃ) একদিকে তাদের দেবতাদের নিন্দা করছিলেন, অপরদিকে সর্বপ্রকার অসৎকার্য ও দুর্নীতির মুলোৎপাটনের জন্য বদ্ধপরিকর হয়ে গুরুগম্ভীর ভাষায় প্রতিবাদ করতে লাগলেন। এজন্য তারা ক্রোধে অধীর হয়ে ইসলামের বিরুদ্ধাচরণ আরম্ভ করল এবং সঙ্গবদ্ধ হয়ে ইসলামকে সমূলে নষ্ট করে দেওয়ার জন্য দৃঢ়সংকল্প হল।
পাঠক, আপনি হয়ত মনে মনে ভাবতেছেন যে, আরবগণ এই মুষ্টিমেয় মুসলমানদেরকে হত্যা করে ইসলামকে অঙ্কুরেই সমূলে ধ্বংস করে ফেলে নি কেন? এর প্রকৃত উত্তর হল এই যে, সত্যকে প্রচার করা আল্লাহর ইচ্ছা। মুহাম্মদ (সাঃ)-কে রিসালাতের পূর্ণত্বে পৌছিয়ে দেয়া পবিত্র কুরআনকে রক্ষা করা এবং তওহীদের উজ্জ্বল আলোকে পূর্ণত্ব দান করার ভার আল্লাহ্ তা'আলা স্বয়ং গ্রহণ করেছিলেন। এই আলোকে মুখে ফুৎকার দিয়ে নির্বাপিত করতে পারে, এই শক্তি কার?
"শত্রুরা আল্লাহর নূর ফুৎকার দিয়ে নিবাতে চায়, কিন্তু আল্লাহ তা'আলা তাঁর নূর পূর্ণরূপে উদ্ভাসিত করবেন যদিও কাফিররা তা অপছন্দ করে।"
এ-কথা সম্পূর্ণ নিঃসন্দেহ যে, সমস্ত কাজ আল্লাহর ইচ্ছায়ই সংঘটিত হয়ে থাকে। কিন্তু দুনিয়া দারুল-আসবাব; এখানে সমস্ত কাজ কোন একটা বাহ্যিক কারণ বা উপকরণের মাধ্যমেই সমাধা হয়ে থাকে। সুতরাং কুরায়শগণ যে, শৈশবেই ইসলামকে গলা টিপে মারার সঙ্কল্প করে নি, এরও একটা বাহ্যিক কারণ ছিল। তারা হল এই যে, আমরা যে-সময়ের কথা কলছি তখন কুরায়শের পরস্পর বিরোধী গোত্রসমূহ আত্মকলহে, গৃহবিবাদে, নানা প্রকার দুর্নীতি ও ব্যভিচারের অবশ্যম্ভাবী ফলে অত্যন্ত দুর্বল ও নিষ্পেষিত হয়ে পড়েছিল। বংশগত ও গোত্রগত হিংসা-বিদ্বেষ তখন চরমে উঠেছিল। সামান্য একটু সুযোগ বা উপলক্ষ পেলেই এক গোত্র অপর গোত্রকে আক্রমণ করে নিজেদের হিংসাবৃত্তি চরিতার্থ করত। বংশগত প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা এবং পর-গোত্রীয় লোক কর্তৃক স্বগোত্রীয় নিহত লোকের প্রতিশোধ বা ক্ষতিপূরণ গ্রহণের জন্য তারা বুভুক্ষ শার্দুলের ন্যায় সতই ঘুরে বেড়াত। এজন্য গোত্রসমূহ সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করার অবকাশ তাদের ছিল না।
দীর্ঘ কাল যাবৎ যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত থাকার ফলে তারা শিথিল হয়ে পড়েছিল। তাদের সামরিক শৃঙ্খলা এবং যুদ্ধশক্তিও অনেকটা বিপর্যস্ত ও বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছিল। এই সমস্ত কারণে তারা স্বতন্ত্র বা সঙ্ঘবদ্ধভাবে ইসলামের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করার সাহস ও শক্তি হারিয়ে বসেছিল। পক্ষান্তরে রাসূল (সাঃ)-কে হত্যা করলে যে তাঁরা স্বগোত্র বনু হাশিম তিলে তিলে তার প্রতিশোধ গ্রহণ করবে এবং এর ফলে আরবময় এক মহাসমর গজায়ে উঠবে, এই আশঙ্কা তাদের ছিল। আর শুধু রাসূল (সাঃ)-কে হত্যা করলেই ত ইসলামের ধ্বংস সাধন হল না। তাঁর অনুসরণকারী সকল মুসলমানকেই ত বধ করতে হবে। ইসলাম গ্রহণের অপরাধে তাঁরা সকলেই সমভাবে অপরাধী। আরবের এমন কোন গোত্র ছিল না, যে-গোত্রের দুই একজন লোক ইসলাম গ্রহণ না করেছিলেন। এদের মধ্য হতে যাঁকেই বধ করবে তাঁর গোত্রই প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য শত্রু হয়ে দাঁড়াবে। এজন্য তারা মুসলমানদের সমূলে ধ্বংস করতে অক্ষম ছিল।
আবার কুরায়শদের মধ্যে কতক লোক এমনও ছিল যারা আত্মকলহ সৃষ্টি করা পছন্দ করত না। তাদের ইচ্ছা ছিল যে, যুদ্ধ বিগ্রহ না করে মুহাম্মদ (সাঃ)-কে এবং তাঁরা মুরব্বীগণকে সরলভাবে বুঝিয়ে শোনিয়ে কোন প্রকারে এই বিষয়টি মিটমাট করে দিতে পারলেই ভাল হয়।
এই সমস্ত কারণে প্রথম প্রথম কুরায়শদের শত্রুতা ও ক্রোধের মাত্রা অপেক্ষাকৃত কমই ছিল। কিন্তু যখন কুরআনের নিম্ন লিখিত আয়াতটি অবতীর্ণ হল এবং রাসূল (সাঃ) ও এই আয়াতের মর্মানুসারে ওজস্বিনী ভাষায় কঠোরভাবে পৌত্তলিকতা ও দেবতাদের নিন্দাবাস করতে আরম্ভ করলেন, তখন তারা অধিক ক্রোধান্বিত ও উত্তেজিত হয়ে উঠল। আয়াতটি এই-
"নিঃসন্দেহে তোমরা এবং আল্লাহর পরিবর্তে তোমরা যাদের পূজা করছ (সে সমস্ত দেবতাগণ) দোযখের ইন্ধন হবে।
চিরদিন যাদেরকে উপাস্য বলে বিশ্বাস করে আসতেছ, যাদের কৃপা-লাভের আশায় মস্তক অবনত করে ঘষাতে ঘষাতে কপালে দাগ বসিয়েছ, আজ সেই দেবতাদের উপর এত বড় আক্রমণ। এই অপমান কিছুতে সহ্য করা যায় না। সুতরাং কুরায়শগণ সমস্ত আত্মকলহ বিস্মৃত হয়ে সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে উঠল এবং মুহাম্মদ (সাঃ)-কে প্রতিরোধ করার জন্য দৃঢ় সংকল্প হল।
তখন মক্কাবাসিগণ খাজা আবু তালিবকে যথেষ্ট ভয় করত। কারণ, সমস্ত বণু 'আন্দে মনাফ তাঁর আজ্ঞাবহ ছিল। তাঁর আহ্বানে এরা নিজেদের প্রাণ দিতেও প্রস্তুত ছিল। আবূ তালিব যখন দেখতে পেলেন যে, প্রিয়তম ভ্রাতুষ্পুত্র মুহাম্মদ (সাঃ)-এর উপর আক্রমণ করার জন্য কুরায়শগণ সঙ্ঘবদ্ধ হচ্ছে, তখন তিনিও তাঁর পক্ষ সমর্থনের কথা মক্কাময় ঘোষণা করে দিলেন। এই ঘোষণার ফলে কুরায়শগণ সঙ্ঘবদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও কোন কিছু করতে সাহস পেল না। মুহাম্মদ (সাঃ) নির্বিঘ্নেই সত্য প্রচার করে যেতে লাগলেন।
পরিশেষেঃ
প্রিয় পাঠক, আজকের আর্টিকেলের মাধ্যমে আমরা বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর জীবনী সিরিজ পর্বের ১০ম পর্ব শেষ করেছি। এই সিরিজের ১১তম পর্বটি পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন।
