মহানবী সাঃ এর নবুওয়তের পঞ্চম বছর
নবুওয়তের পঞ্চম বৎসর
উৎপীড়ন: মুহাম্মদ (সাঃ)-কে হত্যা করার সমস্ত প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হল। একত্ববাদ এবং সত্যের প্রচারও পূর্ণোদ্যমেই আগে বেড়ে চলল। ভীতি প্রদর্শন, প্রলোভন কোন কিছুর দ্বারাই ইসলামের অগ্রগতি প্রতিরোধ করা সম্ভব হল না।
তর্ক-বিতর্ক, বাদ-প্রতিবাদ যা কিছু হচ্ছিল, তা খাজা আবু তালিব এবং কুরায়শদের মধ্যেই হচ্ছিল। মুহাম্মদ মুস্তফা (সাঃ) সেই দিকে ভ্রক্ষেপও করেন না। তিনি অবিচলিত চিত্তে মুক্তকণ্ঠে একত্ববাদ ও সত্য প্রচার করে যেতেছিল। তিনি অহরহ স্বীয় কর্তব্য কর্মে প্রবৃত্ত আছেন। এক দিকে ওহী অবতীর্ণ হচ্ছে অপর দিকে তিনি আয়াতসমূহ পাঠ করে করে লোকদেরকে শুনাচ্ছেন। আল্লাহর একত্ব, মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব এবং পৌত্তলিকতার অসারতা বর্ণনা করতেছেন। মূর্তি পূজা এবং সর্বপ্রকার অসৎ কার্য বর্জন করত সৎকাজ করার জন্য এবং একমাত্র নিরাকার অদ্বিতীয় সর্বশক্তিমান আল্লাহর 'ইবাদত করার জন্য লোকদেরকে উৎসাহ প্রদান করতেছেন। বিশ্বাসীদেরকে নামায, তসবীহ, তাহলীল প্রভৃতি 'ইবাদ বন্দেগীর নিয়ম পদ্ধতি শিক্ষা দিতেছেন।
![]() |
| মহানবী সাঃ এর নবুওয়তের পঞ্চম বছর |
তাঁর পবিত্র মুখে আল্লাহর বাণী শুনে সত্যের নেশায় মানুষ প্রমত্ত হয়ে উঠতেছে। শত্রু দলের প্রধান প্রধান সরদারগণ। নিজেদের স্ত্রী-পুত্র, পারবার পরিজনকে সামলায়ে রাখতে অক্ষম হয়ে পড়েছে। তাদের অনেকেই সত্যের প্রবল আকর্ষণে উতলা হয়ে পবিত্র ইসলাম গ্রহণ করে তাঁরা কঠোর শাস্তি, হত্যার ভীতি, কোন কিছুরই পরওয়া করে না। এতদ্দর্শনে কুরায়শগণ অত্যন্ত সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল। উপায় কি? এখন কি করা যায়।
কুরায়শদের পরামর্শ সভা বসল। কি উপায়ে ইসলামের এই দুর্বার অগ্রগতিকে বাঁধা দেয়া যায় এবং কি রূপে ইসলামের মূলোৎপাটন করে পৌত্তলিকতার অস্তিত্ব বজায় রাখা যায়। এ সম্পর্কে আলোচনা আরম্ভ হল। সরদারগণ বলতে লাগল। "বৃদ্ধ আবূ তালিব তো কিছুই বুঝেন না। ভ্রাতৃপুত্রের ভালবাসায় তাঁর জ্ঞান-চক্ষু অন্ধ হয়ে পড়েছে। হাশিম ও মুত্তালিব গোত্রের নির্বোধ যুবকগণও তাঁর সুরে সুর মিলায়ে ভীষণ অসুবিধার সৃষ্টি করেছে। এখন ত মুহাম্মদ (সাঃ)-কে হত্যা করার কোন উপায় দেখা যাচ্ছে না। আবু তালিবকে কিংবা তাঁর আদরের দুলাল ভ্রাতুষ্পুত্রকে কোন প্রকার প্রলোভন দ্বারা বশীভূত করা ও সম্ভব নয়। এখন উপায় কি? কোন পথ অবলম্বন করা যায়?
এবংবিধ নানা আলোচনার পর শেষ পর্যন্ত সে সিদ্ধান্ত গৃহীত হল, তা এই-সকলকেই নিজ নিজ গোত্রের যে সমস্ত লোক ইসলাম গ্রহণ করেছেন, তাঁদেরকে শাসন করতে হবে এবং মুহাম্মদ (সাঃ)-এর ধর্ম পরিত্যাগ করে পূর্ব ধর্ম প্রত্যাবর্তন না। করা পর্যন্ত তাদেরকে কঠোর শাস্তি দিতে থাকবে। এরূপ বলপূর্বক তাদেরকে ইসলাম পরিত্যাগ করতে বাধ্য করলেই মুহাম্মদ (সাঃ) দুর্বল হয়ে পড়বেন।
কুরায়শগণ ভাবল, ইসলাম ধর্মে এবং স্বীয় সংকল্পে অটল থেকে নিহত হলে, বস্তুত: মুসলমানগণ স্বীয় উদ্দেশ্যে কৃতকার্য হলেন এবং আনন্দের সাথে মৃত্যু বরণ করে জয় লাভ করলেন। পক্ষান্তরে তাদেরকে সংকল্প পরিত্যাগে বাধ্য করতে অক্ষম হওয়ায় আমরা পরাজিত ও অপমানের অধিকারী হলাম। এজন্যই মুসলমানদেরকে হত্যা করা তাদের উদ্দেশ্য ছিল না।
উৎপীড়িত হওয়ার তাৎপর্য:
এই সিদ্ধান্তের পর নিষ্ঠুর কুরায়শগণ মুসলমানদের উপর যে কি অমানুষিক অত্যাচার করেছিল, তা পাঠকগণ শীঘ্রই জানতে পারবেন। কিন্তু আপনারা হয়ত মনে মনে ভাবতেছেন যে, হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সাঃ) হলেন আল্লাহর রাসুল, আর তাঁর ভক্ত সাহাবীগণ (রাঃ) হলেন সত্যের সেবক এবং আল্লাহর প্রিয় বান্দা। তাঁদের উপর এত বিপদ কেন?
হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সাঃ) ছিলেন বিশ্বনবী। তাঁকে নিখিল বিশ্বের এক প্রান্ত হতে অপর প্রান্ত পর্যন্ত প্রত্যেকটি মানুষের কর্ণকুহরে সত্যের আহ্বান পৌঁছাতে হবে। এই মহান উদ্দেশ্য সফলের জন্য এক দল সহায়কদের প্রয়োজন ছিল। তাই আল্লাহ তা'আলা তাঁর হাবীব (সাঃ) এর সহায়করূপে এই প্রাথমিক মুসলমানদেরকে (সাহাবীদেরকে) নির্বাচন করেছিলেন।
তাঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন ঈমানরূপ আকাশের এ একটি উজ্জ্বল চন্দ্র। চন্দ্র যেমন সূর্যের আলোকে স্বয়ং আলোকিত হয় এবং পৃথিবীকে ও আলোকিত করে তদ্রূপ তাঁরা ও নবুওয়ত-ববির সাহচর্যে ও সংস্পশে থেকে ঈমানের উজ্জ্বল আলোকে স্বয়ং আলোকিত হয়ে সারা জাহানকে আলোকিত করার ক্ষমতা অর্জন করেছিলেন। তাঁরা ছিলেন হিদায়তের আকাশের দীপ্তিমান নক্ষত্র এবং মানব সমাজের পরম আদর্শ। দিশাহারা পথিক যেমন নক্ষত্রের সাহায্যে গন্তব্য স্থলে পৌঁছাতে পারে তদ্রূপ তাঁদেরকে আদর্শরূপে গ্রহণ করলেও পথভ্রষ্ট মানুষ পথপ্রাপ্ত হতে পারে। বাসুল (সাঃ)-বলেন-
"আমার সাহাবীগণ নক্ষত্রের ন্যায়। তোমরা তাদের মধ্য হতে যারই অনুসরণ কর না কেন? হিদায়ত পাবে।"
সুতরাং আল্লাহর দরবারে তাঁদের মর্যাদা অতি উচ্চ। আর আল্লাহর নিকট যার মর্যাদা যত বড় তার পরীক্ষাও হয় তত কঠিন। অতএব তাঁরা যে অগ্নি পরীক্ষায় পতিত হবেন এবং সেই পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়ে সমাজের হাদী (পথ প্রদর্শক) এবং দেশ বরেণ্য নেতার পদ লাভ করবেন, এই কথা সুনিশ্চিত। কারণ, খাঁটি স্বর্ণ আগুণে দপ্ত হওয়ার পর এবং নেহাইর উপরে পড়ে হাতুড়ার পিটুনী খাওয়ার পরেই গলার হাররূপে বরেণ্য হয়ে থাকে। এবং নিজের ঔজ্জ্বল্য দ্বারা অপরকে উজ্জ্বল ও সুন্দর করতে সক্ষম হয়।
পক্ষান্তরে এই আদর্শ মানবগণ জগতকে ধৈর্যসমর শিক্ষা দিয়ে গেছেন। প্রবল পরাক্রমশালী শত্রুর সাথে আত্মাধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে অক্ষম হলে ধৈর্য-সমর ঘোষণা করাই জয় লাভের একমাত্র উপায়।
রাসূল (সাঃ) এবং তাঁর ভক্ত সাহাবীগণ (রাঃ) অম্লান বদনে কাফিরদের সমস্ত অত্যাচার ও উৎপীড়ন সহ্য করেছিলেন। তৎসঙ্গে এক মুহূর্তের জন্য নিজেদের কর্তব্য বিস্মৃত হন নি।
অগ্নি পরীক্ষা
কুরায়শদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এবার সত্য সত্যই উৎপীড়ন আরম্ভ হল। ঈমানের কি আশ্চর্য শক্তি। নিষ্পেষণের মাত্রা যতই বাড়ে, ভিতর হতে সে ততই শক্তিশালী হয়ে উঠে। আঘাতপ্রাপ্ত হলে আগুণ যেমন ছড়ায়ে পড়ে, উৎপীড়িত হয়ে ইসলাম ও তদ্রূপ বিস্তার লাভ করতে আরম্ভ করল।
সম্ভ্রান্ত বংশীয় মুসলমানগণ নিজ নিজ গোত্রের হাতে আবদ্ধ হলেন এবং অভিভাবক ও স্বগোত্রীয়গণ কর্তৃক উৎপীড়িত হতে লাগলেন। কিন্তু সহায় সম্বলহীন দরিদ্র মুসলমানদের উপর জুলুমের পাহাড় ভেঙ্গে পড়ল। তাঁদের প্রতি যে অমানুষিক অত্যাচার আরম্ভ হয়েছিল, ইতিহাসে তার তুলনা আছে বললে যালিম কুরায়শদের মর্যাদা ক্ষুন্ন করা হবে। এই সংক্ষিপ্ত পুস্তকে তখনকার অত্যাচারের বিস্তারিত আলোচনা সম্ভবপর হবে না। আমরা তার একটু নমুনা মাত্র প্রকাশ করতেছি।
হযরত বিলাল (রাঃ)
সর্বপ্রথমেই মনে পড়ে ভক্তকুল শিরোমণি হযরত বিলাল (রাঃ)-এর কথা। তাঁর নাম শুনে নাই মুসলমান সমাজে এরূপ লোক অতি বিরল। তিনি ছিলেন একজন হাবশী (কাফ্রী) ক্রীতদাস। কোন এক অশুভ মুহূর্তে তাঁর পিতামাতা যালিমদের হাতে ধৃত হয়ে মক্কাবাসীদের নিকট দাসরূপে বিক্রিত হন। বংশানুক্রমিকভাবে দাসের সন্তান দাসই হয়। সুতরাং হযরত বিলাল ও দাসজীবন অতিবাহিত করতেছিলেন।
হযরত বিলাল (রাঃ) ছিলেন অত্যন্ত কৃষ্ণকায় ও কদাকার। সমাজে এহেন ক্রীতদাসের স্থান নেই। তদানীন্তন সমাজে তারা অত্যন্ত ঘৃণিত ও উপেক্ষিত ছিলেন। কিন্তু বাহিরটা তাঁর কৃষ্ণকায় হলেও ভিতরটা ছিল অত্যন্ত সুন্দর। কয়লার খনির অন্তরাল যেমন করে উজ্জ্বল মণি লুকায়ে থাকে, বিলাল (রাঃ)-এর কুৎসিত দেহের মধ্যে ও তেমনি ছিল একটি জ্যোতিময় আত্মা। তাঁর অন্তর রাজ্যটা আলোকে আলোময় এবং সত্যেই উজ্জ্বল দীপ্তিতে উদ্ভাসিত ছিল। তাঁর শুভ্র স্বচ্ছ দর্পণের নবুওয়তরবির উজ্জ্বল আলো প্রতিফলিত হয়েই এত আলোর সৃষ্টি করেছিল। হযরত বিলাল (রাঃ)-এর প্রভুর নাম ছিল উমাইয়া বিন খলফ। হযরত বিলাল (রাঃ) গোপনে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। মুসলমান হওয়ার পর তিনি সর্বক্ষণ আল্লাহর যিকর ও 'ইবাদতে মশগুল থাকতেন। একথা জানতে পেরে উমাইয়া একেবারে ক্ষিপ্ত সিংহের ন্যায় উত্তেজিত হয়ে উঠল। সে ক্রোধে গড় গড় করতে করতে বলতে লাগল, কি সর্বনাশ। আমারই ক্রীত দাস, আমারই গৃহে থেকে মুহাম্মদ 'তওহীদ'-এর জয় গান গাইবে। কত বড় স্পর্ধা তার। উমাইয়া ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠল। হযরত বিলাল (রাঃ)-কে তৎক্ষণাৎ ডাকায়ে এনে চাবুক মারতে মারতে বলতে লাগল, 'ভাল চাস, এখুনি মুহাম্মদের ধর্ম পরিত্যাগ কর। কিন্তু হয়রত বিলাল (রাঃ) কিছুতেই রাযী হলেন না। অত্যাচারের মাত্রা বেড়ে চলল, কিন্তু হযরত বিলাল (রাঃ) একেবারে অনমনীয়।
তখন উমাইয়া এক অদ্ভুত শাস্তির ব্যবস্তা করল। এখন হতে বিলাল (রাঃ) আর মানুষের মত চলাফেরা করতে পারবে। না। নিকৃষ্ট পশুর ন্যায় তাঁর গলায় দড়ি বেধে মক্কার বালকদের হস্তে তাঁকে সমর্পণ করা হল। বালকেরা প্রত্যহ তাঁকে নিয়ে রাজপথে বের হত, দুষ্ট বালকগণ হেঁচকা টান মেরে তাঁকে মাটিতে ফেলত। তৎপর হৈ হৈ করে দড়ি ধরে হেঁচরাত এবং মেরে পিটিয়ে অর্ধমৃত অবস্থায় সন্ধার সময় উমাইয়ার বাড়ীতে নিয়ে আসত। উমাইয়া তখন তাঁর নিকট উপস্থিত হয়ে বলত, "এখনও ভাল আছে, মুহাম্মদ (সাঃ) এর ধর্ম ত্যাগ কর।"
হযরত বিলাল (রাঃ) তখন নির্ভীক চিত্তে, স্থির কণ্ঠে উত্তর দিতেন "জীবন থাকতে এই ধর্ম ত্যাগ করতে পারব না।" এত বড় স্পর্ধা। বিলাল তাতেও নিবৃত্ত হল না দেখে উমাইয়া অত্যাচারের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিল। হযরত বিলাল (রাঃ)-কে হাত পা বেঁধে দুপুর বেলার প্রখর রৌদ্রতপ্ত মরু বালুকায় চিত করে শোয়ায়ে দেয়া হত এবং যাতে তিনি পার্শ্ব পরিবর্তন করতে না পারেন, সে উদ্দেশ্যে তাঁর বুকের উপর গুরুভার পাথর চেপে দেয়া হত। দুরাচার উমাইয়া তখন সেখানে এসে বলতঃ বিলাল ভাল চাস তবে এখনও মুহাম্মদ (সাঃ)-এর ধর্ম ত্যাগ কর, নৃতবা তা অপেক্ষা ও কঠিন শাস্তির বিধান করব। কিন্তু তিনি অর্ধ-চৈতন্যাবাস্থায় উত্তর দিতেন। এক সেই অদ্বিতীয় এক। এতেও যখন তিনি সত্যভ্রষ্ট হলেন না তখন তাঁর আহার বন্ধ করে দেয়ার ব্যবস্থা করা হল। তিনি যখন ক্ষুধার তাড়নায় ছটফট করতে থাকতেন, তাঁর সমস্ত দেহ অবসন্ন হয়ে পড়ত, তখন উমাইয়া তাঁকে পিঠমোড়া বাঁধ দিয়ে বেত্রাঘাত করতে থাকত এবং বলত। এখনও মুসলমান থাকার সাধ আছে তোমার? বেত্রাঘাতে সারা দেহ জর্জরিত হয়ে শোণিত ধারা গড়ে পড়তে থাকত, আর বিলাল হর্ষিত মনে বলতে থাকতেনঃ আহাদ, আহাদ-তিনি এক, অদ্বিতীয়।
কি পবিত্র স্বর্গীয় দৃশ্য আল্লাহর প্রেমে প্রমত্ত বিলালের সর্বাঙ্গ। শোণিতধারায় অভিষিক্ত, ক্ষুধার তাড়নায় প্রাণ ওষ্ঠাগত। অথচ মুখে সেই এক অদ্বিতীয় প্রভুর জয়-ঘোষণা ঝংকৃত হচ্ছে।
রাত্রিকালেও তাঁকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে দিত না। এক সঙ্কীর্ণ নির্জন প্রকোষ্ঠে আবদ্ধ করে লোম হর্ষক অত্যাচার করতে থাকত এবং বলতে থাকত: এখনও ভাল আছে, মুহাম্মদ (সাঃ)-এর ধর্ম ত্যাগ কর, নতুবা তোমার নিস্তার নেই। হযরত বিলাল তখনও আহাদ, আহাদ বলে 'তওহীদ'-এর জয় ঘোষণাই করতে থাকতেন।
কিছুদিন এইরূপ অত্যাচারই চলতে রইল। তারপর আল্লাহর রহমত অবতীর্ণ হল বিলালের উপর। হযরত আবূ বকর (রাঃ)-এর আর্থিক অবস্থা খুবই সচ্ছল ছিল। হযরত বিলালের দুর্দশার কথা শুনে তাঁর শরীর শিহরিয়ে উঠল। তিনি আর স্থির থাকতে পারলেন না। এক মুহূত বিলম্ব না করে উমাইয়ার নিকট গেলেন এবং অনেক চেষ্টার পর বহু অর্থের বিনিময়ে তার নিকট হতে ক্রয় করে হযরত বিলাল (রাঃ)-কে মুক্ত করে দিলেন।
এই বিলালই মুসলিম জগতের প্রথম মুয়াযযিন। তিনি চির জীবন উচ্চ কণ্ঠে তকবীর ও আযান ধ্বনির মধ্যে 'আল্লাহু আকবর' বলে সেই আহাদের জয়গানে আকাশ বাতাস মুখরিত করে দিয়েছেন।
আল্লাহর প্রেমিক রাসূলের আদর্শ ভক্ত হযরত বিলাল (রাঃ) স্বীয় সংকল্পে অটল থেকে ধর্ম-যুদ্ধে অগণিত শত্রুকে পরাস্ত করলেন এবং আল্লাহর নামের জয়গান গেয়ে সত্য ধর্মের জয়-ভেরী বাজায়ে জগতে অমর হয়ে রইলেন।
মুসলিম জগতের প্রবল প্রতাপান্বিত খলীফা হযরত 'উমর ফারুক এই বিলাল সমন্ধেই বলেছিলেন যে, আমাদের সরদার হযরত আবূ বকর (রাঃ) আমাদের সবদার হযরত বিলাল কে ক্রয় করে মুক্ত করেছিলেন। হযরত উমর (রাঃ) যেভাবে হযরত আবূ বকর (রাঃ)-কে আমাদের সরদার' বলে সম্মান প্রদর্শন করেছিলেন, তদ্রূপ হযরত বিলাল (রাঃ)-এর নামের পূর্বেও ঠিক সেই শব্দটিই ব্যবহার করে উভয়কে সমান মর্যাদা দান করেছেন।
হযরত খাব্বাব (রাঃ)
হযরত খাব্বাব তমীম বংশীয় লোক ছিলেন। প্রাগৈসলামিক যুগে তাঁকে গোলাম বানায়ে বিক্রয় করা হয়। উম্মে আনমার নামক এক মহিলা তাঁকে খরিদ করে। যে সময় রাসূল (সাঃ) সাফা পাহাড়ের পাদদেশে হযরত আরকমের বাসগৃহে থেকে ইসলাম প্রচার করতেন, সেই সময়ে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁর প্রতি কুরায়শগণ যে ভীষণ অত্যাচার করেছিল, তা স্মরণ করতেও শরীর শিহরিয়ে উঠে। তাঁকে যে সমস্ত লোমহর্ষক অগ্নিপরীক্ষাতে পতিত হতে হয়েছিল, তন্মধ্য হতে শুধু একটি ঘটনা বর্ণনা করা হলো।
তাঁর উপর কত রকমের অত্যাচার করা হল। কিন্তু তিনি ইসলাম পরিত্যাগ করতে সম্মত হচ্ছেন না। এজন্য কুরায়শ দলপতিগণ অত্যন্ত চটিয়ে যায়। তখন তারা জ্বলন্ত অঙ্গার মাটিতে বিছাইয়ে তার উপর তাঁকে চিৎ করে শোয়াত এবং কয়েকজন পাষণ্ড তাঁর বুকে পা দিয়ে চেপে ধরে রাখত। যখন পিঠের তলে চাপা পড়ে অঙ্গারগুলো নির্বাপিত হত তখন তারা তাঁকে ছেড়ে দিত। বহুদিন পরে হযরত খাব্বাব (রাঃ) এই ঘটনা হযরত উমরের নিকট বর্ণনা করলেন। তখন হযরত উমর (রাঃ) তাঁর পৃষ্ঠ খুলে দেখতে পেলেন যে, সেই দাহের চিহ্নাবশেষ সারা পিঠে ধবল কুষ্ঠের ন্যায় বিদ্যমান আছে।
হযরত খাব্বাব মুসলমান হওয়ার পূর্বে কর্মকারের কাজ করতেন। তরবারি প্রভৃতি প্রস্তুর করে বিক্রয় করতেন। তখনকার সময়ের অনেক অর্থ-কড়ি জনগণের নিকট তাঁর পাওনা ছিল। মুসলমান হওয়ার পর পাওনা টাকা চাইলে তারা বলত যে, পাবে না। তদুত্তরে তিনি বলতেনঃ যে পর্যন্ত তোমরা মরে আবার জীবিত না হও, সে পর্যন্ত তা সম্ভব নয়। কি ভীষণ অগ্নিপরীক্ষা। ঈমানের কি অসাধারণ প্রভাব। কত যে ছিল তাঁর মনের বল আর ধৈর্য।
ভক্ত পরিবারের অনল পরীক্ষা
হযরত 'আমর (রাঃ) ইয়ামনের অধিবাসী ছিলেন। তাঁর পিতা হযরত ইয়াসির মক্কায় এসে বসতি স্থাপন করেন। ময়ূম গোত্রের আবু হুযায়ফা তাঁর ক্রীত দাসী হযরত সুমায়্যাকে ইয়াসিরের নিকট বিবাহ দেন। তাঁর গর্তেই হযরত 'আম্মার জন্ম গ্রহণ করেন। হযরত 'আম্মার তাঁর আব্বা ও আম্মাজানকে সঙ্গে নিয়ে হযরত আরকমের বাড়ী গেলেন এবং রাসূল (সাঃ)-এর খিদমতে হাযির হয়ে তাঁরা সকলে এক সঙ্গে ইসলাম গ্রহণ করলেন কুরায়শগণ তাঁদের উপর নানাবিধ অসহনীয় অত্যাচার আরম্ভ করল। তাঁদেরকে অসহনীয় বেত্রাঘাত করত এবং উত্তপ্ত মরু-বালুকার উপর শোয়ায়ে রাখত। একদিন এই ভক্ত পরিবারকে ভীষণভাবে অত্যাচারিত হতে দেখে রাসূল (সাঃ) অত্যন্ত আবেগপূর্ণ ভাষায় বলেছিলেন, "হে ইয়াসির পরিবার ধৈর্যাবলম্বন কর। তোমাদের জন্য জান্নাতের সুসংবাদ রয়েছে।"
হযরত ইয়াসির এই অমানুষিক অত্যাচার সহ্য করতে অক্ষম হয়ে নিজের প্রাণ আল্লাহর হাতে সোপর্দ করলেন এবং ধৈর্য-সমরে জয়ী হয়ে জান্নাতবাসী হয়ে গেলেন। (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলায়হি রাজিউন)।
স্বামীর মৃত দেহ এবং বেত্রঘাতে জর্জরিত রক্তাক্ত কলেবর পুত্রকে দেখেও সুমাইয়া ভীত হলেন না। তাঁর ঈমান আরও শক্তিশালী হয়ে উঠল। তিনি 'কালিমা তায়্যিবা' পাঠ করে ইসলামের সত্যতা ঘোষণা করতে লাগলেন। পাপিষ্ঠ আবু জাহল ক্রোধান্বিত হয়ে তাঁর গুপ্ত অঙ্গে বর্ষাঘাত করল। এই আঘাতে তিনিও শহীদ হয়ে গেলেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলায়হি রাজি 'উন)।
অবলা নারী হযরত সুমাইয়া (রাঃ) ঈমানের উপর অটল থেকে অসংখ্য শত্রুদেরকে পরাজিত করলেন এবং বিজয়ী বেশে ঈমানরূপে অমূল্য রত্ন নিয়ে বেহেশতের সিংহাসনে আরোহণ করলেন।
আরও কয়েকজন নিঃসহায়ের বিপদ: পিতা-মাতা চলে গেলেন। এখন একা 'আম্মারের উপর নিত্য নূতন অগ্নি পরীক্ষা চলতে লাগল। তিনি অকাতরে সব সইতে লাগলেন। আল্লাহর কৃপায় তিনিও শেষ পর্যন্ত ঈমানের উপর অটল থেকে কৃতকার্য হলেন।
সুহায়ব রূমী (রাঃ)
সুহায়ব কুমীর পারস্য সম্রাটের প্রতিনিধিরূপে 'আবলা'-এর শাসনকর্তা ছিলেন। তাঁর বংশধরগণ 'মুসিল' এর অধিবাসী ছিলেন যুদ্ধের ময়দানে রূমীদের হাতে বন্দী হয়ে তিনি ক্রীতদাসে পরিণত হন। দীর্ঘকাল যাবত রোম দেশে অবস্থান করার কারণে ভালভাবে আরবী বলতে পারতেন না। এ জন্য তাঁকে কর্মী বলা হত। আরবী বণিকদের হাতে বিক্রীত হয়ে মক্কায় আসেন এবং 'আবদুল্লাহ ইবন জুদ'আন তাঁকে ক্রয় করে দাসত্ব হতে মুক্তি দান করেন। তিনিও হযরত 'আম্মারের সাথে হযরত আরকমের বাসভনে রাসূল (সাঃ)-এর নিকট ইসলাম গ্রহণ করেন। কুরায়শগণ তাঁর উপর এত অত্যাচার করত যে, তিনি প্রহৃত হতে হতে অজ্ঞান হয়ে পড়তেন। কিন্তু নিমেষের জন্য তাঁর অন্তর দুর্বল হয় নি। তিনি যখন হিজরত করে মদীনায় প্রস্থান করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন, তখন কুরায়শ-দলপতিগণ তাঁকে বলল যে, যদি তোমার ধন-সম্পত্তি সর্বস্ব ছেড়ে যাও তবে যেতে পার। সুহায়ব (রাঃ) বললেন: নবী-চরণের একটা ধূলিকণার সমান মর্যাদাও এই ধন-সম্পত্তির নেই। তিনি প্রফুল্লচিত্তে যথাসর্বস্ব বিসর্জন দিয়ে মদীনায় চলে গেলেন।
হযরত আবু ফুকায়হা (রাঃ)
হযরত আবু ফুকায়হা (রাঃ) ছিলেন সফওয়ান ইবন উমাইয়ার গোলাম এবং তিনি হযরত বিলাল (রাঃ)-এর সাথে মুসলমান হয়েছিলেন। উমাইয়া তার মুসলমান হওয়ার কথা শুনতে পেয়ে তাঁর পায়ে দড়ি বেঁধে উত্তপ্ত বালুকা ও প্রস্তরময় স্থান দিয়ে হেঁচড়াবার জন্য লোকদেরকে আদেশ দিল। পথিমধ্যে অতি কদাকার একটা গোবরে পোকা দেখতে পেয়ে উমাইয়া তাঁকে বললঃ এটাই তোর উপাস্য নাকি? তিনি উত্তর করলেন: "এটা উপাস্য নয়, তোমার এবং আমার উপাস্য হলেন আল্লাহ তা'আলা।" এজন্য উমাইয়া এমন শক্তভাবে তাঁর গলা টিপে ধরল যে, তাঁর প্রাণবায়ু বের হয়ে যাওয়ার উপক্রম হল। আর একবার তাঁর বুকের উপর এত ভারী পাথর চাপা দিয়াছিল যে, তাঁর জিহবা বের হয়ে পড়েছিল।
হযরত লবীনা (রাঃ)
হযরত লবীনা ছিলেন হযরত 'উমরের দাসী। তাঁকে মারতে মারতে হযরত 'উমর ক্লান্ত হয়ে পড়লে বলতেন যে, আমি দয়া করে তোমাকে ছেড়ে দেই নি; বরং ক্লান্ত হওয়ার দরুন বিশ্রাম করতেছি। আবার বত্রাঘাত আরম্ভ করব। হযরত লবীনা (রাঃ) অত্যন্ত সুস্থিরভাবে উত্তর দিতেন-হে 'উমর, তুমি যদি ইসলাম গ্রহণ না কর তবে আল্লাহ্ তার প্রতিশোধ নিবেন।
যুনায়রা
ইনি হযরত 'উমরের পরিবারের দাসী ছিলেন। ইসলামের পূর্বে হযরত 'উমর তাঁকে প্রাণের সাধ মিঠায়ে অত্যাচার করতেন। আবু জাহল তাঁকে মারতে মারতে চক্ষু দুটি নষ্ট করে দিয়েছিল।
হযরত নাহদিয়া ও হযরত উম্মে উবায়স (রাঃ)
এই মহীয়সী মহিলাদ্বয়ও দাসী ছিলেন। তারাও মুসলমান হওয়ার অপরাধে অত্যন্ত কঠোর উৎপীড়ন ভোগ করেছিলেন।
হযরত আবূ বকর (রাঃ) বিরাট ধনভাণ্ডার নিঃশেষ করে তাদের অধিকাংশকেই এই অমানুষিক অত্যাচার হতে উদ্ধার করে ছিলেন। হযরত বিলাল হযরত 'আমির, হযরত লবীনা, হযরত মুনায়বা, হযরত নাহদিয়া এবং হযরত উম্মে, 'উবায়স (রাঃ) তিনি অতি দুর্মূল্যে ক্রয় করে দাসত্ব হতে মুক্ত করে দিয়েছিলেন। সহায় সম্বলহীন এবং দরিদ্র হওয়ার দরুন যাঁদের উপর ব্যাপকভাবে অমানুষিক অত্যাচার করা হত, এখানেই তাঁদের আলোচনা শেষ করলাম। আর সম্ভ্রান্ত গোত্রের মুসলমানদের মধ্যে যাঁরা নানারূপে অত্যাচরিত হতেন তাঁদের কয়েকজনের কথা সংক্ষেপে আলোচনা করে আমরা এই প্রসঙ্গ শেষ করব।
সম্ভ্রান্ত বংশীয় মুসলমানদের পরীক্ষা: ইসলাম জগতের তৃতীয় খলীফা হযরত 'উসমান (রাঃ) একজন সম্ভ্রান্ত সম্পদশালী লোক ছিলেন। তিনি মুসলমান হওয়ার কারণে কুরায়শগণ তাঁর উপর অত্যান্ত ক্ষেপে উঠল। তাদের প্ররোচনায় তাঁর চাচা তাঁকে হাত পা বেঁধে নিমর্মভাবে প্রহার করতে আরম্ভ করে। তিনি আল্লাহর নামে ধৈর্য ধারণ করে নীরবে সব উৎপীড়ন বরদাশত করেছিলেন।
হযরত আবূ যর গিফারী (রাঃ) ইসলামের দীক্ষিত হয়ে কা'বা গৃহে প্রবেশ করলেন এবং নিজের মুসলমান হওয়ার কথা প্রকাশ করলেন। তখন কুরায়শগণ তাঁকে মারতে মারতে আধমরা করে ফেলে। মুসলমান হওয়ার অপরাধে হযরত যুবায়র বিন 'আওয়ামকে তার চাচা চাটাইয়ের ভিতর জড়ায়ে ধুয়া দিত এবং বলত "যদি বাঁচতে চাও, তবে মুহাম্মদ (সাঃ)-এর ধর্ম পরিত্যাগ কর।" হযরত উমরের চাচাত ভাই এবং ভগ্নিপতি যায়দ যখন ইসলাম গ্রহণ করলেন, তখন হযরত উমর তাঁকে রজু দ্বারা শক্ত করে বেঁধে রাখেন।
তখন যে মুসলমানদের প্রতি এ ধরনের কত অমানুষিক ও অকথ্য অত্যাচার হয়েছিল। হাদীসের বিশ্বস্ত গ্রন্থসমূহ পাঠ করলে তা সমাকরূপে অবগত হওয়া যায়। হযরত আবু বকর এবং হযরত 'আলী ব্যতীত আর প্রায় সকলেই এভাবে নিপীড়িত হয়েছিলেন। মক্কার উত্তপ্ত মরুপ্রান্তর এই পরীক্ষার কেন্দ্রস্থল ছিল। এতদ্ভিন্ন গভীর পানিতে নিক্ষেপ করা, ডুবায়ে দেওয়া, উত্তপ্ত প্রস্তরের 'ছেঁকা' দেওয়া, অতি ভারী লৌহ বর্ম বিজড়িত করে জ্বলন্ত বালুর উপর ফেলে রাখা প্রভৃতি নানাবিধ অত্যাচারও কম হত না।
অত্যাচার কমিটি
এ পর্যন্ত যত প্রকার শাস্তিই দেওয়া হল, তাতে একটি লোককেও ইসলাম ছেড়ে দিতে বাধ্য করা সম্ভব হল না। সুতরাং এই শাস্তি যথেষ্ট নয়। শাস্তির ধারা ও কঠোরতা নির্ধারিত হওয়া উচিত। এই উদ্দেশ্যে পাঁচশ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর জীবনী গঠিত হল। রাসূল (সাঃ)-এর চাচা আবু লাহাব হল এই কমিটির সভাপতি। এখন হতে এই কমিটির ব্যবস্থানুসারেই শাস্তি দেওয়া আরম্ভ হল।
এই কমিটিতে যে সব সমস্যার সমাধান হয়েছিল, তন্মধ্যে একটি ছিল এই যে, মুহাম্মদ (সাঃ)-এর এমন একটা আখ্যা প্রদান করতে হবে যা শুনামাত্রই লোকেরা তাঁর প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে যায়।
প্রথম সদস্য বললঃ তাঁকে কাহিন বা দৈবজ্ঞ বলে আখ্যা দেওয়া হউক।
ওলীদ বলল: এটা সঙ্গত হবে না। এমন কথা বললে জনগণ আমাদেরকে মিথ্যাবাদী বলবে। কারণ মুহাম্মদ (সাঃ)-এর এবং দৈবজ্ঞদের মন্ত্রের মধ্যে আকাশ পাতালের পার্থক্য।
দ্বিতীয় সদস্য বললঃ আমরা তাঁকে পাগল বলে আখ্যা দিব।
ওলীদ বললঃ কোথায় পাগল। আর কোথায় মুহাম্মদ" মুহাম্মদ (সাঃ) হলেন সভ্য, শান্ত, গাম্ভীর্যপূর্ণ, কত বড় শালীন লোক। এমন সন্ধ্যান্ত ব্যক্তিকে যে পাগল বলবে, লোকেরা তাকেই পাগল বলে মনে করবে।
তৃতীয় সদস্য বলল: তাঁকে শা'ইর বা কবি বলে আখ্যায়িত করলেই ঠিক হবে।
ওলীদ বলল: দুনিয়ার মানুষ তো সবই বোকা নয়, কবিতা কাকে বলে, তা কি আর তারা জানে না? মুহাম্মদ (সাঃ)-এর কুরআনের সাথে কবিতার লেশ মাত্রও মিল নেই।
চতুর্থ সদস্য বলল: আমরা তাঁকে জাদুকর বা ঐন্দ্র জালিক বলে প্রসিদ্ধ করব।
ওলীদ বলল: জাদুগরীর উৎপত্তি হল অপবিত্রতা হতে। তোমরা দেখ না, জাদুকরদের কাপড়-চোপড় কেমন নোংড়া। চেহারা কত কুৎসিত। চাল-চলন ও স্বভাব-চরিত্র কত কদর্য। ভিতরে বাইরে চির পূত-পবিত্র ফেরেশতা-স্বভাব মুহাম্মদ (সাঃ)-কে তোমরা জাদুকর বললে তোমাদের কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। ফলে তোমরা মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত হবে। এবার সদস্যমণ্ডলী সমবেতভাবে সমস্বরে বলে উঠল: তবে চাচাজান, তাঁকে কি আখ্যা দিলে ভাল হবে, তা আপনিই বলে দিন।
ওলীদ বললঃ সত্য সত্যই মুহাম্মদ (সাঃ)-এর স্বভাব চরিত্রও অনুপম এবং তাঁর কথাবার্তাও মাধুর্যপূর্ণ। তাঁকে লোকের নিকট দোষারোপ করতে হলে শুধু একটি কথা বলা চলে, তা হল এই: মুহাম্মদ (সাঃ) অশান্তিও বিভেদ সৃষ্টিকারী মানুষ। তাঁর কথা শুনলে ভাই-ভাইয়ের মধ্যে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে, পিতা-পুত্রের মধ্যে বিবাদের সৃষ্টি হয়। এজন্য তাঁর সাথে চলা-ফেরা এবং আলাপ-আলোচনা করা উচিত নয়।
তৎপর উক্ত কমিটিতে নিম্ন লিখিত সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতি ক্রমে গৃহীত হল-
১. বিভিন্নভাবে মুহাম্মদ (সাঃ)-কে বিরক্ত করতে হবে; প্রতি কাজেই তাঁকে ব্যঙ্গোক্তি করা এবং কথায় কথায় তাঁকে বিদ্রূপ ও উপহাস করে অস্থির করে তুলতে হবে।
২. তাঁর ধর্ম পরিত্যাগ না করা পর্যন্ত তাঁর বিশ্বাসী ভক্তদের উপর অসহনীয় অত্যাচার ও কঠোর উৎপীড়ন চালিয়ে যেতে হবে।
কমিটির পরামর্শ অনুযায়ী মক্কা নগরের চতুর্দিকে প্রত্যেক রাস্তায় এক একজন করে লোক নিযুক্ত করা হল। বিদেশ হতে আগত হজ্জযাত্রীদেরকে মক্কা নগরে প্রবেশ করার পূর্বে পথের মধ্যেই তারা বলে দিত, "বর্তমানে এখানে মুহাম্মদ (সাঃ) নামক একজন জাদুকর আছে। সে পিতা-পুত্র, স্বামী-স্ত্রী এবং অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে ঝগড়া বাঁধায়ে দিয়ে বিচ্ছেদের সৃষ্টি করে। সাবধান" তোমরা তার নিকটে যেও না।" কিন্তু তার ফল উল্টা দাঁড়াল কারণ, যাঁরা রাসূল (সাঃ)-এর সম্বন্ধে কিছুই জানত না তারা পথে এই সংবাদ শুনে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠত এবং তাঁর সম্মুখে উপস্থিত হয়ে অতি মনোযোগ সহকারে তাঁর বক্তৃতা শ্রবণ করত। এরূপে বিদেশী লোকদের নিকট ইসলাম প্রচারের সুযোগ আরও বৃদ্ধি পেল।
