মহানবী (সাঃ)-এর প্রতি অসদ্ব্যবহার কাহিনী

একদা রাসূল (সাঃ) পবিত্র কা'বা গৃহে নামায পড়তেছিলেন। কুরায়শ দলপতিগণ ও তথায় সমবেত ছিল। আবূ জাহল বলল, "অমুক স্থানে একটি উট যবেহ করা হয়েছে। তার নাড়ীভুঁড়িগুলো সেখানেই পড়ে রয়েছে। তোমাদের মধ্য হতে জনৈক ব্যক্তি যেয়ে সেগুলো উঠায়ে নিয়ে আস এবং মুহাম্মদ (সাঃ) যখন সিজদা করবে, তখন তাঁর গ্রীবাদেশে রেখে দাও। পাষণ্ড 'উক্তা তৎক্ষনাৎ যেয়ে সেগুলো নিয়ে আসল এবং রাসূল (সাঃ) তাঁর গ্রীবাদেশের উপর রেখে দিল।

রাসূল (সাঃ) আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন ছিলেন বিধায় তাদের অসদ্ব্যবহার অনুভব করতে পারেন নি। কাফিরগণ হাঁসতে হাঁসতে মাটিতে লুটায়ে পড়ল।

অদূরেই হযরত 'আবদুল্লাহ্ ইবন মাসউদ পাপিষ্ঠ কাফিরগণের অসদ্ব্যবহার দেখতেছিলেন। কিন্তু তিনি তাদের ভয়ে কিছুই করতে সাহস পাচ্ছিলেন না। বেহেশতের রানী, রাসুর কন্যা হযরত ফাতিমা (রাঃ) দৌড়ে এসে তাঁর গ্রীবাদেশের উপর হতে নাড়ীভুঁড়িগুলো ঠেলে ফেলে দিলেন এবং দুরাচার কাফিরদেরকে তিরষ্কার করলেন।

Mistreatment of the Holy Prophet (PBUH)
মহানবী (সাঃ)-এর প্রতি অসদ্ব্যবহার

এরূপে রাসূল (সাঃ)-এর প্রতি অসদ্ব্যবহার এবং সাহাবীদের প্রতি কঠোর অত্যাচারের মাত্রা ক্রমশঃ বৃদ্ধি পেতে লাগল। তাঁরাও অম্লান বদনে সবকিছু সহ্য করে যেতে লাগলেন। কোন একজন মুসলমানকে তারা ইসলামচ্যুত করতে পারল না।

 হাবশায় হিজরত 

যখন অত্যাচারের মাত্রা ভীষণ হতে ভীষণতর হয়ে দাঁড়ায় তখন সাহাবায়ে কিরাম রিযওয়ানুল্লাহি 'আলায়হিম-এর নিরাপত্তার জন্য মূর্ত রহমত রাসূলের অন্তর অস্থির হয়ে উঠল। দৈহিক অত্যাচারে মুসলমানগণ মোটেই অতিষ্ঠ হন নি। কিন্তু সবচাইতে বড় বিপদ হল এই যে, তারা প্রকাশ্যভাবে নামায এবং অন্যান্য ইবাদত বন্দেগী করতে পারতেছেন না। এমনকি গোপনে নামায পড়াও অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়েছে। বাস্তবিক যাঁরা সত্যিকার মুসলমান, তাঁরা সবকিছু সহ্য করতে পারেন। কিন্তু ধর্মের উপর আঘাত পড়লে কিছুতেই তা সহ্য করতে পারেন না।

এখন পর্যন্ত কোন মুসলমানই আল্লাহর ঘরে প্রবেশ করে উচ্চৈঃস্বরে কুরআন মজীদ পাঠ করতে পারেন না। হযরত 'আবদুল্লাহ ইবন মাস'উদ (রাঃ) ইসলাম গ্রহণ করার পর এই কর্তব্য সমাধা করার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হলেন। সুতরাং তিনি পবিত্র কা'বা গৃহে প্রবেশ করলেন এবং মাকামে ইবরাহীমের নিকটে দাঁড়ায়ে উচ্চৈঃস্বরে 'সূরা-আররাহমান' পড়তে আরম্ভকরলেন। কাফিরগণ চতুর্দিক হতে দলে দলে এসে তাঁকে আক্রমণ করল এবং তাকে চপেটাঘাত করতে লাগল। কিন্তু আল্লাহর অটল প্রেমিক, নাছোড়বান্দা ইবন মাস'উদ (রাঃ) যে-পর্যন্ত পড়ার সংকল্প করেছিলেন, সে-পর্যন্ত শেষ না করে এক পাও সরলেন না। পরে দেখা গেল তাঁর মুখমণ্ডলে আঘাতের দাগ বসে গেছে।

অন্যান্য কুরায়শ সরদারদের তুলনায় হযরত আবু বকরের মর্যাদা ও প্রতিপত্তি কোন দিক দিয়ে ন্যূন ছিল না। তথাপি তিনি উচ্চৈঃস্বরে কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করতে পারতেন না। এজন্য তিনিও একবার দেশ ত্যাগের জন্য প্রস্তুত হয়ে ছিলেন।

মোট কথা কাফিরদের শাস্তি ও শৃঙ্খলার সাথে ধর্মানুষ্ঠান সমাপণ করা অসম্ভব হয়ে পড়ছিল। এজন্যই রাসূল (সাঃ) মুসলমানদেরকে দেশত্যাগ করে শান্তির স্থানে চলে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন।

সেকালে আবিসিনিয়া (হাবশা)-এর খৃষ্টান সম্রাট নাজ্জাশী ন্যায়পরায়ণ ও সুবিচারক বলে সর্বত্র বিশেষতঃ কুরাইদের নিকট সবিশেষ সুখ্যাতি লাভ করেছিলেন। অতি পূর্বকাল হতেই কুরাইগণ বাণিজ্য উপলক্ষে তথায় যাতায়াত করত। এজন্য তারা তথাকার অবস্থা সম্পর্কে সম্যকরূপে অবগত ছিল। সুতরাং রাসূল (সাঃ) মুসলমানদেরকে মক্কা হতে হিজরত করে হাবশায় গমণ করার অনুমতি দিলেন।

পরে দেশ ত্যাগের কথা জানতে পেরে কুরাইগণ কোন একটা বিভ্রাট ঘটায়, এই আশঙ্কায় তাঁরা গোপনে গোপনে সমস্ত আয়োজন করলেন। আল্লাহর প্রেমিক বারজন পুরুষ এবং চারজন মহিলা ঘরবাড়ি, আত্মীয়-স্বজন, স্বদেশ স্বজাতিকে বিসর্জন দিয়ে আল্লাহর উদ্দেশ্যে অজানা দুর্গম দেশে যাত্রা করলেন। গোপনীয় বিষয়কে গোপন রাখতে সক্ষম হওয়া কৃতিত্বের প্রথম ও প্রধান লক্ষণ। এ-বিষয়েও তাঁরা পূর্ণ বিচক্ষণতার পরিচয় দিলেন। তাঁরা আবশ্যকীয় সমস্ত সামগ্রী নিয়ে সদল বলে বের হয়ে 'শু' আয়বা' বন্দরে চলে গেলেন। কিন্তু কুরায়শগণ ঘূর্ণাক্ষরেও একথা জানতে পারল না।

নবুওয়তের পঞ্চম রজব মাসে তাঁরা 'শু'আয়বা' বন্দর হতে জাহাজে আরোহণ করে আবিসিনিয়া (হাবশা) অভিমুখে যাত্রা করলেন। এই তারিখে যে মহাত্মাগণ হাবশায় হিজরত করলেন, আমরা এখানে তাঁদের নামের তালিকা প্রদান করলাম।

১. হযরত 'উসমান ইবন 'আফফান: ইনি বংশ মর্যাদায় এবং ধন-সম্পদে কুরায়শদের মধ্যে খ্যাতনামা ছিলেন। ইনিই মুহাজির দলের দলপতি (আমীর) ছিলেন।

২. হযরত রুকায়্যা: রাসূল (সাঃ)-এর কন্যা এবং হযরত উসমানের স্ত্রী।

৩ হযরত আবু হুযায়ফা: কুরায়শের প্রধান সরদার 'উত্তার পুত্র। তাঁর পিতা কাফির ছিল। এজন্য তিনি দেশান্তরিত হতে বাধ্য হন।

৪. হযরত সাহলা: ইনি হযরত আবু হুযায়ফার স্ত্রী।

৫. হযরত যুবায়র বিন 'আওয়াম: সা'আদ বংশের রাসূল (সাঃ)- এর ফুফাত ভাই ও প্রসিদ্ধ সাহাবী।

৬. হযরত মুস'আব বিন 'উমাইর। গোষ্টিপতি হাশিমের পৌত্র।

৭. হযরত 'আবদুর রহমান ইবন 'আওফঃ রাসুল (সাঃ) এর মাতুল বংশীয় মুদ্রা গোত্রের কুরায়শ বংশস্তুত সর্দার।

৮. হযরত আবূ সালামা। কুরায়শ বংশীয় জনৈক প্রধান ব্যক্তি।

৯. হযরত উম্মে সালামা। হযরত আবূ সালামার স্ত্রী। পরে রাসূল (সাঃ)-এর সাথে তাঁর বিবাহ হয়েছিল। হাবশার অনেক ঘটনা তাঁর প্রমুখাৎ জানা যায়।

১০. হযরত উসমান বিন মর্য'উন: জনৈক প্রসিদ্ধ সাহাবী।

১১. হযরত আমির বিন রবী'আঃ হযরত উসমান হজ্জ যাত্রাকালে তাঁকে মদীনায় শাসনকর্তা নিযুক্ত করেছিলেন।

১২. হযরত লায়লা বিনত আবু হায়সা। তিনি ছিলেন হযরত 'আমিরের স্ত্রী।

১৩. হযরত আবু সায়া: রাসূল (সাঃ)-এর ফুফু বার্তার পুত্র।

১৪. হযরত আবু হাতিব বিন 'আমব: জনৈক সাহাবী।

১৫. হযরত সুহায়ল বিন বয়যাঃ তিনিও একজন প্রসিদ্ধ সাহাবী ছিলেন।

১৬. হযরত 'আবদুল্লাহ বিন মাস'উদ: প্রসিদ্ধ সাহাবী ও মুহাদ্দিস।

পাঠক হয়ত মনে করবেন, যাঁদের সাহায্য করার কেউ ছিল না, তাঁরাই বুঝি উৎপীড়নে অধৈর্য হয়ে মাতৃভূমি পরিত্যাগ করতে বাদ্য হয়েছিলেন। বস্তুতঃ তা মোটেই নয়। যাঁরা সর্বক্ষণ অত্যাচারে জর্জরিত থাকতেন, যাঁদেরকে অগ্নি-শয্যায় শয়ন করতে বাধ্য করা হত, যাঁরা এক মুহূর্তের জন্যও শাস্তির নিঃশ্বাস নিতে পারতেন না। উল্লিখিত তালিকায় তাঁদের নাম দেখতে পাওয়া যায় না। হযরত বিলাল, হযরত 'আম্মার, হযরত য়্যাসির প্রমুখ সাহাবীগণ (রাঃ) সবচাইতে নিমর্মভাবে অত্যাচারিত হচ্ছেন। কিন্তু তাদের মধ্যে কেউ দেশ ত্যাগ করে হাবশায় যান নি। পক্ষান্তরে প্রাথমিক মুহাজির যোল জন নরনারীর মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন সম্ভ্রান্ত বংশীয় এবং সংগতিসম্পন্ন। হযরত 'উসমান ছিলেন উমাইয়া বংশীয় লোক। সে কালে উমাইয়া বংশ যে মক্কার শীর্ষস্থান অধিকার করে বসেছিল, একথা পাঠকগণ পূর্বেই জানতে পারচ্ছেন। হযরত যুবায়র ও হযরত মুস'আব স্বয়ং রাসূল (সাঃ) -এর স্ববংশীয় লোক ছিলেন। হযরত 'আব্দুর রহমান এবং হযরত আবূ সাবরাও সাধারণ লোক ছিলেন না। এই ক্ষমতাশালী মহাত্মগণও দেশ ত্যাগ করে হাবশায় হিজরত করেছিলেন।

তাতে মনে হয় যে, সম্ভ্রান্ত এবং অবস্থাপন্ন ঘরের মুসলমানগণ ও কুরায়শদের অত্যাচার হতে অব্যাহতি পান নি এবং নির্বিঘ্নে ধর্ম কর্ম সম্পন্ন করার উদ্দেশ্যেই তাঁরা দেশ ত্যাগ করেছিলেন। আর হযরত বিলাল, হযরত আম্মার প্রমুখ দরিদ্র নিঃসহায় মুসলমানগণ এতই দুর্গত হয়ে পড়েছিলেন যে, পাথেয় সংগ্রহ করাও তাঁদের জন্য সম্ভবপর হয় নি অথবা তাঁরা রাসূল (সাঃ)-কে একা শত্রুদের নিকটে রেখে যেতে তাঁদের মনে মানে নি।

বস্তুতঃ যাঁরা দেশ ত্যাগ করেছিলেন এবং যাঁরা করেন নি, তাঁরা কেউ মহত্ ও ত্যাগের কারও অপেক্ষা কম ছিলেন না। সবকিছুই বিসর্জন দিয়ে অজানা দেশে প্রস্থানের মধ্যে যেমন ধর্মানুরাগ, সৎ সাহস, ত্যাগ ও মহত্ত্ব ছিল; সমস্ত বিপদকে বরণ করে রাসূল (সাঃ)-এর পার্শ্বে থেকে পবিত্র ধর্মের জয় গান করার মধ্যেও তেমনি ছিল অকৃত্রিম ধর্ম-প্রেরণা, গুরুভক্তি, সত্যাগ্রহ চরিত্র-বল।

যা হউক, হাবশা যাত্রিগণ যখন শু'আয়বা বন্দরে পৌঁছলেন, তখন উক্ত বন্দর হতে দুটি বাণিজ্য জাহাজ আবিসিনিয়া অভিমুখে রওয়ানা হল। এজন্য জাহাজের মালিকগণ অতি অল্প ভাড়ায় তাঁদেরকে জাহাজে উঠায়ে নিল। জন প্রতি মাত্র পাঁচ দিরহাম ভাড়া দিতে হয়েছিল।

কুরায়শগণ যখন জানতে পারল যে, কতিপয় শিকার তাদের হাত-ছাড়া হয়ে যাচ্ছে, তখন তারা ভয়ানক হিংস্র হয়ে উঠল। হাবশা-যাত্রী মুসলমানদেরকে ধরে আনবার জন্য তৎক্ষনৎ তারা একদল লোক শু'আয়বা বন্দরের দিকে প্রেরণ করল। কিন্তু তারা উক্ত বন্দরে পৌছিয়েই শুনতে পেল যে, মাত্র কিছুক্ষণ পূর্বেই আবিসিনিয়ার জাহাজ বন্দর ছেড়ে চলে গেছে। তখন তারা অগত্যা অন্তরের ক্রোধ অন্তরে চাপা দিয়ে নিরাশ মনে প্রত্যাবর্তন করতে বাধ্য হল। অনুচরগণ মক্কায় পৌঁছে কুরায়শদেরকে নিরাশার সংবাদ দিল। পরাজয়ের কলঙ্কে ও ক্রোধানলে তখন তারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ল। তখন তারা কিরূপে তার প্রতিশোধ নিবে, এ কথাই ভাবতে লাগল।

 মুহাজিরগণের প্রত্যাবর্তন 

ধর্মানুরাগী আল্লাহভক্ত নওমুসলিম সাহাবীগণ নিরাপদে আবিসিনিয়ায় পৌঁছিলেন। আবিসিনিয়া-রাজ নাজ্জাশী আনন্দের সাথে সসম্মানে তাঁদেরকে নিজ রাজ্যে বাস করার অনুমতি দিলেন। তাঁরাও তথায় নির্বিঘ্নে ধর্ম কর্ম পালন করতে লাগলেন।

এইরূপে নিরুপদ্রবে তিনটি মাস কেটি গেল। তৎপর হঠাৎ আবিসিনিয়ায় প্রচারিত হল যে, মক্কায় কুরায়শগণ ইসলাম গ্রহণ করেছে। সুতরাং মক্কা এখন দারুল ইসলামে পরিণত হয়েছে এবং তথায় নির্ঝঞ্ঝাটে ধর্ম কর্ম পালন করা যায়। এ সংবাদ শুনে মহাজিরগণ (রাঃ) মক্কায় ফিরে আসলেন। কিন্তু নগরে প্রবেশ করার পূর্বেই তাঁরা জানতে পারলেন যে, সংবাদটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। তখন কিছুলোক সে স্থান হতেই আবার হাবশায় ফিরে গেলেন। অবশিষ্ট কতক লোক চুপে চুপে মক্কায় প্রবেশ করলেন এবং প্রত্যেকই কোন শক্তিশালী লোকের আশ্রয় গ্রহণ করলেন।

তবরী প্রভৃতি অধিকাংশ ইতিহাসেই এ ঘটনাটি বর্ণিত হয়েছে। কুরায়শগণ ইসলাম গ্রহণ করেছে বলে হাবশায় গুজব প্রচারিত হয়েছিল, তার কারণ ছিল এই-একদিন রাসূল (সাঃ) কা'বা গৃহে সূরা 'আন-নাজম' তিলাওয়াত করতেছিলেন। তখন তথায় কুরায়শগণ সমবেত ছিল। তিনি উক্ত সুরা শেষ করে যখন সিজদা করলেন, তখন কয়েকজন কাফির ব্যতীত অন্যান্য কাফিরগণ এবং মুসলমানগণ সকলেই তাঁর সাথে সিজদা করল। 'সহীহ বুখারীতে আছে-

"সূরা আন-নাজমের মধ্যে রসূল (সাঃ) সিজদা করলেন এবং তাঁর সাথে মুসলমান, মুশরিক, জ্বিন এবং মানুষ সকলেই সিজদা করল।

যেহেতু এই সূরায় সিজদা করার নিদের্শ আছে এবং রাসূল (সাঃ)-এর প্রতি বহু নেয়ামত প্রদানের উল্লেখ আছে, এজন্য আল্লাহর নির্দেশ পালন এবং নেয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশার্থ রাসূল (সাঃ) এবং মুসলমানগণ সিজদা করেছিলেন। কিন্তু কাফিরগণ তাঁদের সাথে সিজদা করার কারণ কি? তার কারণ এইরূপ বর্ণিত হয়েছে এবং সূরাতে তওহীদ ও রিসালাতের সত্যতার পূর্ণতত্ত্ব এইরূপ মাধুর্যপূর্ণ প্রাঞ্জল ভাষায় বর্ণিত হয়েছে যে, তা শুনে কাফিরগণ ক্ষণিকের তরে আত্মবিস্মৃত হয়ে তন্ময় হয়ে পড়েছিল এবং অনিচ্ছাকৃতভাবেই সত্যের প্রতি অভিভূত হয়ে রাসূল (সাঃ)-এর সাথে সিজদা করেছিল। আবার কেউ কেউ বলেছেন যে, এ সূরাতে পৌত্তলিকদের উপাস্য দেবতা লাত 'উয্যা এবং মানাতের নাম শুনে তারা আনন্দিত হয়ে রাসূল (সাঃ)-এর সাথে সিজদা করেছিল।

তবরী প্রভৃতি কিতাবসমূহে তার আরও একটি কারণ বর্ণিত হয়েছে। তা এই, রাসূল (সাঃ) যখন এই সূরা তিলাওয়াত করতেছিলেন তখন কুরায়শগণ তথায় সমবেত ছিল। তাদের অভ্যাস ছিল যে, তিনি যখন কুরআন তিলাওয়াত করতেন তখন তারা খুব হট্টগোল করত এবং তাঁর সুরে সুর মিলায়ে কুরআনের আয়াতসমূহের ফাঁকে ফাঁকে নানা প্রকার অবান্তর কথা পাঠ করে কুরআনের সঙ্গে মিলায়ে দিত। উপস্থিত লোকেরা যেন খাঁটী কুরআন শুনতে না পারে, এই উদ্দেশ্যেই তারা এইরূপ করত।পবিত্র কুরআনেও এই কথার উল্লেখ আছে। কাফিরগণ বলত-

"এই কুরআন শুনিও না তাতে গণ্ডগোল লাগায়ে দাও। তবে হয়ত তোমরা (মুসলমানদের উপর) জয়ী হতে পারবে।

রাসূল (সাঃ) যখন সূরা নাজম পড়তে পড়তে "তোমরা (কখনও) লাত, 'উযযা এবং তৃতীয় মানাত (প্রভৃতি মূর্তিসমূহ উপাস্য হওয়ার যোগ্য কিনা, তদ্‌সম্পর্কে চিন্তা করে দেখেছো কি?) এই আয়াতে পৌঁছলেন তখন কোন এক শয়তান। (কুরায়শী কাফির) তাঁর সুরে সুর মিলায়ে বলল: এই (মূর্তিসমূহ) উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন এবং সম্মানিত, তাদের সুপারিশ (আল্লাহর দরারে) গ্রহণীয় হবে বলে আশা করা যায়।"

দূরে অবস্থিত কুরায়শগণ মনে করল যে, রাসূল (সাঃ)-ই বুঝি এই বাক্যটি পাঠ করেছেন। তাতেই তারা আনন্দিত হয়ে রাসূল (সাঃ)-এর সাথে সিজদা করল।

 পুনঃ হিজরত 

সমাগত প্রবাসীদের উপর কুরায়শদের অত্যাচারের আর অবধি রইল না। পলাতক শিকার পুনঃ ফাঁদে পতিত হয়েছে, কাজেই তারা অত্যাচারের মাত্রা অত্যধিক বাড়ায়ে দিল। কিছুদিন এভাবে কঠোর উৎপীড়নের ভিতর অতিবাহিত হওয়ার পর তাঁরা পুনঃ হিজরত করতে বাধ্য হলেন। কিন্তু এবার পলায়ন করা সহজ ব্যাপার ছিল না। কুরায়শগণ সর্বদা তাঁদের গতিবিধির প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখত। এতদসত্ত্বেও যে কোন প্রকারেই হউক সর্বপ্রথম হযরত 'আলীর ভাই হযরত জা'ফর বিন আবু তালিব হাবশা অভিমুখে যাত্রা করলেন। তৎপর অন্যান্য মুসলমানগণও কেউ কেউ সপরিবারে আর কেউ কেউ একা একা তার পদাঙ্ক অনুসরণ করলেন। যে সকল মুসলমান মক্কা হতে হিজরত করে হাবশায় (আবিসিনিয়ায়) সমবেত হলেন, তাঁদের সংখ্যা ছিল তিরাশি। তাঁরা হাবশায় পৌছিয়ে নির্বিঘ্নে কালাতিপাত করতে লাগলেন এবং নিঃসঙ্কোচে নিজেদের ধর্ম কর্ম পালন করতে লাগলেন।

কুরায়শদের নূতন ষড়যন্ত্র: হাবশা-রাজ নাজ্জামীর সুবিচারে বহু নবদীক্ষিত মুসলমান পরম সুখে জীবন যাপন করছেন এবং নিরাপদে আল্লাহর 'ইবাদত বন্দেগী করতেছেন, এই সংবাদ পেয়ে কুরায়শ প্রধানগণের অন্তরে দাউ দাউ করে হিংসার দাবানল জ্বলে উঠল। তারা আর স্থির থাকতে পারল না। কি উপায়ে মুসলমানদের সুখ-শান্তি নষ্ট করা যায়, সে চিন্তায় তারা উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠল। অবশেষে যুক্তি পরামর্শ করে তারা স্থির করল যে, হাবশা-রাজের নিকট একদল প্রতিনিধি প্রেরণ করে ফেরারী আসামী বলে তাঁদেরকে ধরে আনতে হবে।

এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করার জন্য এবং স্বীয় উদ্দেশ্যে সফলতা লাভের জন্য তারা পর্যাপ্ত পরিমাণে অর্থ ব্যয় করতে কোন প্রকার ত্রুটি করল না। তারা হাবশা-রাজ নাজ্জাশী এবং তাঁর দরবারী অমাত্যবর্গকে উপঢৌকণ দেওয়ার জন্য বহু মূল্যবান ও মনোরম সামগ্রী সংগ্রহ করল। আবিসিনিয়ায় আরবের চামড়ার খুব সমাদর ছিল। এজন্য উৎকৃষ্ট চামড়ার তৈয়ারী সামগ্রীই অধিক পরিমাণে সংগ্রহ করা হয়েছিল।

রাজা নাজ্জাশী ও তাঁর পরিষদবর্গকে পরিতুষ্ট করা যেতে পারে, এই পরিমাণ দ্রব্যসামগ্রী সংগ্রহ করার পর তারা নিজেদের প্রতিনিধিরূপে হাবশায় প্রেরণের জন্য 'আবদুল্লাহ বিন রবী'আ ও আমর বিন আস্ (মিশর বিজয়ী)-কে নির্বাচন করা হল। কারণ কুরাশদের মধ্যে তারা দুই জনই অত্যন্ত বিচক্ষণ ও সুচতুর ছিল।

প্রতিনিধিগণ যথাসময়ে ঐ সমস্ত উপঢৌকন নিয়ে আবিসিনিয়ায় পৌঁছল। তারা রাজার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার পূর্বে সভাসদ পাদরী ও অমাত্যবর্গের সাথে প্রথমেই সাক্ষাৎ করল। তাঁদেরকে বহুমূল্য উপঢৌকন প্রদান করে পূর্বাহ্নেই বশীভূত করে নিল। তৎপর বলতে লাগল। দেখুন, আমাদের কতকগুলো নির্বোধ বালক ও যুবক স্বীয় পূর্বপুরুষদের সনাতন ধর্ম পরিত্যাগ করে একটা মনগড়া নির্বোধ ধর্মের সৃষ্টি করেছে। এই নব আবিষ্কৃত ধর্মটি আমাদের এবং আপনাদের উভয় ধর্মের বিপরীত এই নব ধর্মালম্বীদের দ্বারা আমাদের এবং আপনাদের সকলেই ধর্মের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এজন্য অঙ্কুরেই এই ধর্মটির মূলোৎপাটন করা কর্তব্য। এইরূপ আলাপ আলোচনার পর উভয় দলের সমবেত সিদ্ধান্ত হল যে, কুরায়শ প্রতিনিধিগণ রাজ-দরবারে নিজেদের ফেরারী আসামীদেরকে তাদের হাতে সমর্পণ করার প্রার্থনা জানালে পরিষদবর্গ একবাক্যে এই কথার সমর্থন করবেন এবং রাজা যাতে মুসলমানদের কথা না শুনে তাদেরকে প্রতিনিধিদ্বয়ের হাতে সমর্পণ কবেন, তজ্জনা অমাত্যবর্ণ ও সভাসদ পাদ্রীগণ যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন।

এই ষড়যন্ত্র করার পর কুরায়শ-প্রতিনিধিদ্বয় রাজদরবারে উপস্থিত হয়ে যথাবিধি অভিবাদন আদায় পূর্বক নিজেদের মূল্যবান উপঢৌকনসমূহ পেশ করল। রাজা আগমণের কারণ জিজ্ঞেস করলে তারা বলল: মহারাজ, মক্কার সম্ভ্রান্ত বংশীয় দলপতিগণ আমাদেরকে আপনার খিদমতে প্রতিনিধিরূপে প্রেরণ করেছেন। আমাদের দেশের কতিপয় নির্বোধ যুবক নিজেদের পূর্বপুরুষদের সনাতন ধর্ম পরিত্যাগ করতে একটি নূতন ধর্ম আবিষ্কার করে দেশে নানা প্রকার অশান্তি ও অনর্থের সৃষ্টি করেছিল। বর্তমানে তারা আপনার রাজ্যে আশ্রয় গ্রহণ করেছে। তাদের মনগড়া ধর্ম আমাদের ধর্মও নয় আপনাদের ধর্মও নয়, বরং মনগড়া নূতন। তাদের অভিভাবগণ তাদেরকে ফিরায়ে পাবার প্রার্থনা জানাবার জন্য আমাদেরকে আপনার খিদমতে প্রেরণ করেছেন। দয়া করে আপনি তাদেরকে আমাদের হাতে সমর্পণ করুন। তাদের অভিভাবকগণই তাদের কার্যকলাপের বিচার করবেন।

প্রতিনিধিদলের প্রার্থনা শেষ হওয়া মাত্রই পূর্ব ষড়যন্ত্র অনুসারে সভাসদবর্গ সমস্বরে বলে উঠলেন-মহারাজ, কথা সত্য। তাদের ভাল-মন্দের বিচার তাদের অভিভাবকের হাতে ছেড়ে দেওয়াই সঙ্গত।

রাজা নাজ্জাশী তাতে সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। তিনি বললেন: "এটা কি কথা। এই নিরীহ প্রবাসিগণ আমাকে ন্যায়পরায়ণ মনে করে আমার রাজ্যে আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। আমি তাদের কোন কথা না শুনেই যে তাদেরকে তাদের হাতে সমর্পণ করব-তা কখনও হতে পারে না। বেশ, প্রবাসীদেরকে দরবারে উপস্থিত করা হউক।"

অবিলম্বে মুসলমানদের প্রতি রাজ-দরবারে হাযির হওয়ার নির্দেশ আসল। তারা সমবেত হয়ে রাজ-দরবারে উপস্থিত হলেন। নাজ্জাশী তাঁদেরকে সম্বোধন করে বললেনঃ তোমরা নিজেদের পৈতৃক ধর্ম পৌত্তলিকতা বর্জন করেছ, অথচ দুনিয়ার প্রচলিত অন্য কোন ধর্ম গ্রহণ কর নি, পক্ষান্তরে তোমরা নাকি, কি একটি নূতন ধর্ম আবিষ্কার করেছ, সে ধর্মটি কি? তা খুলে বল।

মুসলমানদের পক্ষ হতে হযরত জাফর (হযরত আলীর ভ্রাতা) স্বীয় স্বভাবসিদ্ধ ওজস্বিনী ভাষায় নিঃসঙ্কোচে উত্তর করলেন: 'রাজন, আমরা ছিলাম অজ্ঞ ও বর্বর জাতি। আমরা আল্লাহকে ভুলে এতদিন নান্য দেব-দেবীর মূর্তি পূজা করতাম। মৃত জীব-জন্তুর মাংস ভক্ষন করতাম। আমাদের অন্তর নানা প্রকার কুসংস্কার ও অন্ধ বিশ্বাসে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। আমরা আত্মীয়-স্বজনের প্রতি দুর্ব্যবহার প্রতিবেশীদের উপর অত্যাচার ও উৎপীড়ন করতাম এবং সর্বদা আত্মকলহে নিমগ্ন থাকতাম। আমাদের প্রবলগণ দুর্বলদেরকে গ্রাস করে ফেলত। মোটকথা আমাদের মধ্যে অনাচ অবিচার ও অসদ্ব্যবহারের অবধি ছিল না। "ঠিক এই দুর্দিনে আল্লাহ তা'আলা দয়া করে আমাদের মধ্যে একজন পয়গম্ব প্রেরণ করলেন। তিনি পূর্ব হতেই আমাদের মধ্যে বংশ মর্যাদায়, সত্যনিষ্ঠায়, বিশ্বস্ততায় ও চরিত্রের নির্মলতায় সুখ্যাতি লাভ করেছেন। তিনি আবির্ভূত হয়ে আল্লাহকে এক ও অদ্বিতীয় বলে বিশ্বাস করতে এবং একমাত্র তাঁরই ইবাদত করতে আমাদেরকে আহবান করলেন। ভূত-প্রেত প্রভৃতি পূজা পরিত্যাগ করে একমাত্র আল্লাহর ইবাদত কর। সত্য কথা বল, আত্মীয় স্বজন ও প্রতিবেশীর সাথে সদ্ব্যবহার কর, নামায পড়, রোযা রাখ, যাকাত দাও, পরোপকার কর; আর্ড ও গীড়িতের সেবা কর, মিথ্যা কথা বলও না, অত্যাচার, ব্যভিচার, হ্যাডীমের সম্পতি গ্রাস, সতী সান্ত্রী নারীর চরিত্রে কনভ আরোগ করও না। সর্বপ্রকার কলুষতা হতে সকলকে পবিত্র রাখ।

আমরা তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে তাঁর প্রতি ঈমান আনয়ন করেছি। তিনি আমাদেরকে যে সব কাজ করতে নির্দেশ দিয়েছেন আমরা তাই করি, আর যে সব কাজ করতে নিষেধ করেছেন তা হতে দূরে সরে থাকি।

"মহাজন আমরা এই পবিত্র ধর্ম গ্রহণ করেছি বলে আমাদের আত্মীয় স্বজন এবং কুরায়শ দলপতিগণ আমাদের প্রতি অমানুষিক অত্যাচার আরম্ভ করে দিয়েছে। অনন্যোপায় হয়ে আমরা দেশত্যাগী হয়েছি। স্বয়ং আমাদের পয়গম্বত হধরত মুহাম্মদ (সাঃ) আপনার ন্যায়বিচারের কথা শুনে আমাদেরকে আপনার রাজ্যে পাঠায়ে দিয়েছেন। এক্ষণে আমাদেরকে ফিরায়ে নিয়ে গিয়ে পুনরায় অত্যাচার করার মানসেই কুরায়শ-দূতগণ আপনার নিকট উপস্থিত হয়েছে।

"শাহেনশাহ্, যদি আপনি তাদের প্রার্থনা অনুযায়ী আমাদেরকে ফিরে যেতে আদেশ দেন, তবে এবার আর আমাদের রক্ষা নেই।"

জা'ফরের ওজয়িনী বক্তৃতা শ্রবণ করে বিশ্বয় বিমুদ্ধ নাজ্জাশী বললেন তোমাদের রাসূলের প্রতি আল্লাহর যে বাণী অবর্তীণ হয়েছে, তার কোন অংশ আমাকে শুনাতে পার কি?

হযরত জা'ফর (রাঃ) তখন সূরা-মরইয়মের প্রারম্ভ হতে হযরত 'ঈসা (আঃ) ও তদীয় মাতা হযরত মরইয়ম সংক্রান্ত কয়েকটি আয়াত সুললি করে পাঠ করলেন। পবিত্র কুর'আনের মাধুর্যপূর্ণ ভাষ্য সরল ও বোধগম্য যুক্তিতর্ক এবং ইসলামের সভাপ্রিয়তার উদার ভাবাবেগে সভাস্থ জনমণ্ডলী অভিভূত হয়ে পড়ল। নাজ্জাশী আত্মসংবরণ করতে পারল না। তাঁর নয়নযুগল হতে অশ্রুধারা প্রবাহিত হয়ে শ্মশ্রুরাজি সিক্ত হতে লাগল। বিশ্বয় বিমুদ্ধচিত্তে নাজ্জাশী করুণস্বরে বলতে লাগলেন, "এই পবিত্র বাণী এবং হযরত 'ঈস্য যে বাণী প্রাপ্ত হয়েছিলেন উভয় একই প্রদীপের আলো।" অতঃপর কুরায়শ-প্রতিনিধিদেরকে বললেনঃ তোমরা চলে যাও, তোমাদের প্রার্থনা না মন্যুর, আমি তাদেরকে কিছুতেই তোমাদের হাতে সমর্পন করব না। 

Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url