মহানবী সাঃ এর জীবনী | Biography of the Prophet Muhammad (PBUH)-Ep-11

আসসালামু আলাইকুম, প্রিয় পাঠক আজকের আর্টিকেল এর মাধ্যমে আমি আপনাদের সাথে শেয়ার করবো মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর সম্পুর্ন জীবনী বাংলা সিরিজ আর্টিকেল  এর  ১১তম পর্ব সম্পর্কে। আপনি যদি 'মহানবী সাঃ এর সম্পুর্ন জীবনী' এই সিরিজ আর্টিকেলে নতুন হয়ে থাকেন এবং ১০ম পর্বটি পড়তে চান তাহলে এখানে ক্লিক করে আগের পর্বটি পড়ে নিতে পারেন। চলুন আজকের পর্ব শুরু করা যাক-

 আবু তালিবের নিকট অভিযোগ 

কুরায়শ দলপতিগণ সমবেত হয়ে পরস্পর বলতে লাগলেন। মুহাম্মদ (সাঃ)ত শুধু আমাদের চরিত্রের উপরই আক্রমণ করছে না; বরং আমাদের পূর্বপুরুষ এবং আমাদের মহামহিম দেবতাদের উপরও মারাত্মক আক্রমণ চালিয়ে যেতেছেন। চল, আমরা তাঁর পক্ষ সমর্থনকারী অভিভাবক আবু তালিবের নিকট ফরিয়াদ করে দেখি, তিনি তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রকে বারণ করেন কিনা। সুতরাং তারা দলবদ্ধভাবে আবু তালিবের নিকটে যেয়ে অভিযোগ জানাল। তারা আবূ তালিবকে সম্বোধন করে বলতে লাগল। জনাব, আপনার ভাতুষ্পুত্র আমাদের দেবদেবীদেরকে গালমন্দ করতেছে, আমাদের ধর্মের নিন্দা করছে, আমাদের পূর্বপুরুষদের ধর্মভ্রষ্ট ও নির্বোধ বলে ভর্ৎসনা করছে। তাঁর এই সমস্ত উপদ্রব আমরা আর সহ্য করতে পারছি না। অতএব আপনার নিকট আমাদের নিবেদন এই যে, আপনি তাঁকে বারণ করুন। অন্যথায় আমাদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটবার দৃঢ় সম্ভাবনা রয়েছে।

মহানবী সাঃ এর জীবনী রচনা pdf
মহানবী সাঃ এর জীবনী

আবু তালিব নম্রভাবে মিষ্ট বাক্য দ্বারা তাদেরকে নানা প্রকার প্রবোধ দিয়ে বিদায় করলেন। এদিকে রাসূল (সাঃ) পূর্ণোদ্যমে নিজের কর্তব্য পালন করে যেতে লাগলেন। আবু তালিবের নিকট কুরায়শদের অভিযোগ করার কারণে তাঁর প্রচার কার্যে বিন্দুমাত্রও শিথিলতা আসল না। বরং তিনি আরও দ্বিগুণ উৎসাহের সাথে প্রচার কার্য চালিয়ে যেতে লাগলেন।

এর ফলে আবু তালিবের উপর কুরায়শদের অসন্তোষের মাত্রা ক্রমশঃ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হতে লাগল এবং সর্বত্র রাসুল (সাঃ)-এর কার্যকলাপের তীব্র সমালোচনা হতে আরম্ভ হল। কয়েক দিন পরে অর্ধের্য কুরায়শরা পুনরায় খাজা আবু তালিবের নিকট আপীল করতে মনস্থ করল।

'উত্তরা বিন রবী'আ, শায়বা, আবূ সুফাইয়ান, 'আস্ বিন হিশাম, আবু জাহল, ওলীদ, 'আস বিন ওয়ায়িল প্রমুখ কুরায়শ প্রধানগন সঙ্ঘবদ্ধভাবে খাজা আবু তালিবের নিকট উপস্থিত হয়ে বলতে লাগলঃ "দেখুন, আপনার প্রবীণতা, আপনার বংশগৌরব ও আপনার উচ্চ মর্যাদার প্রতি আমরা সকলেই সম্মান প্রদর্শন করে থাকি। এজন্য আমরা আপনার ভ্রাতৃপুত্র সম্বন্ধে আপনাকে সতর্ক করেছিলাম। কিন্তু দুঃখের বিষয় আপনি এর কোনই প্রতিকার করেন নি। আজ আমরা আপনাকে শেষবারের মত জানিয়ে দিতে চাই যে, আমরা আর তাঁর অত্যাচার সহ্য করতে পারব না। হয় আপনি তাঁকে নিবৃত্ত করুন, নতুবা আপনিও যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হন। আপনাদের আমাদের মধ্যে শেষ মীমাংসা না হওয়া পর্যন্ত আমরা ক্ষান্ত হব না। কুরায়শ দলপতিগণের কঠোর প্রতিজ্ঞার কথা শুনে, এবং তাদের রোষানল উপলদ্ধি করে আবু তালিব আপাততঃ বিচলিত হয়ে উঠলেন। তিনি ভাবতে লাগলেন, "এখন সমস্যা বড় জটিল হয়ে উঠেছে। তারা হয়ত আর ধৈর্য ধারণ করবে না, আর একা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার শক্তিও আমার নেই।"

এ সমস্ত কথা চিন্তা করে আবু তালিব মুহাম্মদ মুস্তফা (সাঃ) কে ডেকে এনে কুরায়শ সবদারদের সমস্ত কথা শুনালেন এবং স্নেহমাখা স্বরে বললেন, "বাবা, একটু বিবেচনা করে কাজ কর, অসহনীয় ভার আমার মাথায় চাপালে আমি তা কি রূপে বহন করব।"

আবু তালিবের কথা শুনে রাসূল (সাঃ) মনে মনে ভাবতে লাগলেন, "পার্থিব সহায় বলতে এই পিতৃব্য ব্যতীত আমার আর কেউ নেই। আজ বুঝি, তিনিও আমার সঙ্গ প্ররিত্যাগ করছেন। পরীক্ষা ছিল অত্যন্ত কঠোর। আর হযরতের হৃদয়ও ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী এবং সুপ্রশস্ত। তিনি বিন্দুমাত্রও বিচলিত হলেন না। চাচা কাফিরদের হাতে আমাকে সোর্পদ করে দিতে চাইলে দিবেন, কোন পরওয়া নেই। আল্লাহই ও আমার সহায় আছেন।

এসব কথা চিন্তা করে রাসূল (সাঃ) আবূ তালিবকে সম্বোধন করে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললেনঃ "চাচাজান, আমি যা কিছু করি, সব আল্লাহ তা'আলার নির্দেশেই করি, আমার নিজের ইচ্ছায় কিছুই করি না। এরা (কুরায়শ দলপতিগণ) যদি আমার ডান হাতে সূর্য এবং বাম হাতে চন্দ্র এনে ও রেখে দেয়, তবুও আমি সত্য প্রচার করা হতে বিরত থাকব না। হয়ত আল্লাহ তা'আলা শৌত্তলিকতা ও বহুত্ববাদকে ধ্বংস করে তওহীদকে জয়যুক্ত করত ইসলামের বিধান প্রতিষ্ঠিত করবেন, না হয় আমি আমার প্রাণ এই সত্য প্রচারেই উৎসর্গ করে ফাংসপ্রাপ্ত হব। কোন ক্ষমতাই আমাকে সতা-প্রচার হতে নিরস্ত রাখতে পারবে না।"

এ কথা বলতে বলতে তাঁর নয়নযুগল অশ্রুপূর্ণ হয়ে উঠল। তিনি ব্যথিত হৃদয়ে আবু তালিবের নিকট হতে প্রস্থান করলেন।

তাঁর পবিত্র মুখ নিঃসৃত বাণী এবং তাঁর অন্তরের অটল সংকল্প, দৃঢ় প্রতিজ্ঞা এবং অদম্য প্রেরণা নিষ্ক্রিয় রইল না। আবু তালিবের অন্তরেও এর প্রতিচ্ছায়া প্রতিফলিত হয়ে উঠল। তিনি আর স্থির থাকতে পারলেন না। স্নেহমাখা হরে, করুণ কণ্ঠে ডাকলেন, "প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্র, আস, আমার নিকটে আস।" শ্রদ্ধেয় চাচাজানের আহবানে তিনি ফিরে আসলেন। আবূ তালিব বললেনঃ "যাও, তোমার যা ইচ্ছা, তাই বল এবং তোমার যা ইচ্ছা, তা কর। আমার দেহে প্রাণ থাকতে আমি তোমাকে শত্রুদের হাতে সমর্পণ করব না।"

 মহানবী সাঃ কে হত্যা করার নূতন ফন্দি 

কুরায়শগণ যখন দেখল যে, ভীতি প্রদর্শনে কোনই ফল হল না; বরং রাসূল (সাঃ)-এর সমর্থনে আবু তালিব এখন আরও অধিকতর দৃঢ়তা অবলম্বন করেছেন এবং তাঁকে রক্ষা করার জন্য তিনি বদ্ধপরিকর হয়েছেন। তখন তারা রাসূল (সাঃ)-কে হত্যা করার জন্য আরও কোন একটা নূতন ফন্দির চিন্তা করতে লাগল।

সাধারণত: মানুষ জগৎকে নিজের মতই মনে করে থাকে। মানুষ যে কর্তব্যের খাতিরে নিঃস্বার্থভাবে কোন কাজ করতে পাবে, এ কথা তাদের ধারণায়ও আসল না। তারা মনে করল, বৃদ্ধ আবু তালিবকে কোন একটা প্রলোভন দ্বারা বশে আনা যাবে। এই ধারণায়ই তারা একটা নূতন ফন্দি স্থির করল এবং 'উমারা বিন ওলীদ নামক সুদর্শন, বুদ্ধিমান, সুবক্তা ও ধনাঢ্য যুবককে সঙ্গে নিয়ে আবু তালিবের নিকট উপস্থিত হল। তারা আবূ তালিবকে সম্বোধন করে বলল আপনি উমারাকে পুত্ররূপে গ্রহণ করুন। সে অতি ভাল লোক। পরিণামে তার দ্বারা আপনার যথেষ্ট উপকার হবে। আর তাঁর পরিবর্তে আপনার ভ্রাতুষ্পুত্রকে আমাদের হাতে সমর্পণ করুন। আমরা তাকে হত্যা করব। যেহেতু মানুষের বিনিময়ে মানুষ চাইতেছি এইজন্য আপনার কোন প্রকার আপত্তি না করা উচিত।

আবু তালিব বিদ্রূপ মিশ্রিত কঠোর হবে উত্তর করলেন, বাঃ তোমরা ত বড় মজার কথা বলছ। ভবিষ্যতে উপকৃত হব এই আশায় আমি তোমাদের প্রদত্ত পুত্রকে লালন-পালন করব। আর তার পরিবর্তে তোমরা আমার পুত্রকে হত্যা করবে। তোমাদের এই ইনসাফ ত বড় চমৎকার। তোমরা কি আমাকে বোকা মনে করছ? এটা কখনও হতে পারে না।

কুরায়শ প্রতিনিধিদলের সাথে 'আদীর পুত্র মৃত ইমও এসেছিল। সে আবু তালিবকে সম্বোধন করে বললঃ "জনাব, আপনার বংশধরগণ আপনাকে যে কথা বলতেছে, তা খুবই সমীচীন, কোন অন্যায় কথা নয়। কারণ, তারা আপনার ভ্রাতুষ্পুত্র কর্তৃক অত্যাচারিত হয়ে ভীষণভাবে উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠেছে। বারবার ফরিয়াদ করা সত্ত্বেও আপনি তার কোন প্রতিকার করতেছেন না।"

আবূ তালিব দৃঢ় কণ্ঠে উত্তর দিলেনঃ আল্লাহর কসম, এটা সম্পূর্ণ অবিচার ও অন্যায় কথা। হে মুত'ইম, এটা তোমার ষড়যন্ত্র। তুমিই তাদেরকে এসব ফন্দি শিক্ষা দিয়েছ। যাও, তোমরা যা করতে পার কর। আমার প্রাণ থাকতে আমি আমার প্রিয়তম ভাতিজাকে পরিত্যাগ করব না। তিনি আরও বললেন- "সন্ধ্যার সময় উটের পাল বাড়ী ফিরলে যদি কোন উট নিজ শাবক পরিত্যাগ করে অপর শাবকের প্রতি আকৃষ্ট হয় তবে আমি আমার ভ্রাতুষ্পুত্রকে তোমাদের হাতে সোপর্দ করে অন্যের সন্তান গ্রহণ করব।"

তোমরা কি আমাকে উটের চেয়েও বোকা মনে করেছ? সে নির্বোধ পশু হয়েও নিজ সন্তানের পরিবর্তে অন্যের সন্তান গ্রহণ করে না, আর আমি জ্ঞান-বিবেক সম্পন্ন মানব হয়ে তোমাদের এই অন্যায় কথায় সম্মত হব কি রূপে? তৎপর 'আবদে মনাফ বংশের যে সমস্ত লোক শত্রুপক্ষ অবলম্বন করেছিল, তাদেরকে লক্ষ্য করে অতি হৃদয়-বিদারক ও করুণ স্বরে তিনি একটি নাতিদীর্ঘ কবিতা পাঠ করেন। কবিতাটির প্রারম্ভে এই ছিল-

"জলন্ত অঙ্গার যেমন অগ্নিস্ফুলিঙ্গকে নিক্ষেপ করে তদ্রূপ আমার বিশিষ্ট ও ঘনিষ্ট বংশধর আবদে শামস ও নওফল গোত্রদ্বয় আমাদেরকে দূরে নিক্ষেপ করেছে। আত্মশ্লাঘা ব্যতীত যাদের পিতার নামধাম এবং কোন প্রকার বংশ মর্যাদা নেই, এরূপ একদল নীচু লোককে তারা নিজেদের সমমর্যাদা দান করেছে।"

খাজা আবূ তালিব রাসূল (সাঃ)- কে সান্ত্বনা দিয়ে আর একটি কবিতা আবৃত্তি করলেন। তা এই-

"হে ভ্রাতৃপুত্র, আল্লাহর কসম, যে পর্যন্ত অমি মৃত্তিকাগর্তে প্রোথিত না হই সে পর্যন্ত শত্রুগণ সমবেত হয়েও তোমার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে কখনই সক্ষম হবে না। তুমি নিঃসঙ্কোচে তোমার ধর্ম প্রকাশ্যভাবে প্রচার করতে থাক, তুমি প্রফুল্ল থাক, তোমার নয়নযুগল শীতল থাকুক। তুমি আমাকে সত্য ধর্মের দিকে আহ্বান করেছ এবং বলেছঃ হে চাচাজান, আমি আপনার মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী। নিঃসন্দেহে তুমি সত্য বলেছ, এ সম্পর্কে পূর্ণ বিশ্বস্ত তুমি যে-ধর্ম লোক সম্মুখে উপস্থাপিত করেছ আশঙ্কা না থাকত তবে আমি প্রশান্ত অন্তঃকরণে এবং প্রকাশ্যভাবে তোমার এই ধর্ম গ্রহণ করতাম।"

 হাশিম ও মুত্তালিব গোত্রদ্বয় দৃঢ়তা 

কুরায়শগণ প্রাণ প্রিয়তম ভ্রাতুষ্পুত্রকে হত্যা করার সংকল্প করেছে, এই কথা অবগত হয়ে আবু তালিবের প্রাণ শিহরিয়ে উঠল। তিনি অতান্ত বিচলিত হয়ে পড়লেন। অবিলম্বেই তিনি হাশিম ও মুত্তালিব বংশের লোকদেরকে সমবেত করে বললেন। : "কুরায়শের অন্যান্য গোত্রের লোকেরা আমার ভাতিজাকে হত্যা করার জন্য নানা প্রকার ষড়যন্ত্র করতেছে। তোমরা কি এই বিপদে আমার সহায়তা করবে।" আবূ তালিবের কথা শুনে হাশিম ও মুত্তালিব বংশীয় লোকদের পুরাতন আগুন জ্বলে উঠল। একমাত্র আবু লহব ব্যতীত আর সকলেই সিংহনিনাদে হুংকার ছেড়ে সমস্বরে উত্তর করলঃ "নিশ্চয়ই আমরা প্রস্তুত আছি। আপনার ভাতিজার প্রতি রোষ-কষায়িত নেত্রে যে ব্যক্তি দৃষ্টি করবে, আমরা তার চক্ষু খুলে নিব। সুতরাং তারা সকলেই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হল।

এই প্রতিজ্ঞার কথা অবগত হয়ে শত্রুদল বিশেষতঃ আবু জাহল ও তার সহচরগণ অত্যন্ত ভগ্নোৎসাহ হয়ে পড়ল। এতদিনে তারা বুঝতে পারল যে, মুহাম্মদ (সাঃ)-কে হত্যা করা সুদূর পরাহত ব্যাপার। এবার রাসূল (সাঃ)-এর প্রাণের শত্রু চাচা আবূ লহবও হতাশ হয়ে পড়ল। আবু লহবের প্ররোচণায় হাশিম ও মুত্তালিব বংশীয় কতক লোক শত্রুদের পক্ষ অবলম্বন করেছে। তাদের এই স্বগোত্র-বিরোধিতা এবং অসদাচরণের প্রতি আক্ষেপ করে এবং হাশিম ও মুত্তালিব বংশের লোকদের প্রতিজ্ঞার প্রতি আনন্দ প্রকাশ করে আবূ তালিব একটি কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন। উক্ত কবিতায় তিনি বলেছিলেনঃ সারা 'আরবের কুরায়শগণ তাদের সমস্ত শক্তি ব্যয় করলে ও বধূ হাশিমের এক গাছা পশম পর্যন্ত বাঁকা করতে সমর্থ হবে না।  

 উতবার প্রলোভন 

রাসূল (সাঃ)-কে হত্যা করতে না পেয়ে কুরায়শদের ভীষণ অন্তর্দাহ আরম্ভ হল। মনের ঝাল মিটাবার জন্য তারা তাঁকে নানা প্রকারে কষ্ট দিতে আরম্ভ করল। নামায পড়ার সময় তাঁর উপর অপবিত্র আবর্জনা নিক্ষেপ করত, বিদ্রূপ করে এবং নানা প্রকার কটু বাক্য বলে তাঁকে মর্মাহত করার চেষ্টা করত, তাঁর যাতায়াত-পথ কন্টকাবৃত করে রাখত, পথে কন্টক নিক্ষেপের ব্যাপারে আবু লহবের স্ত্রী ছিল সবচাইতে বেশী অগ্রণী। এজন্যই সূরা 'লাহাব-এ তার উল্লেখ করা হয়েছে। একদিন রাসূল (সাঃ) হরম শরীফে নামায পড়তেছিলেন। এমন সময় পাপিষ্ঠ 'উত্কা ইবন আবূ মু'আয়ত তাঁর গলায় চাদর জড়ায়ে সজোরে হেঁচকা টান মারল। তাতে তিনি উপুড় হয়ে পড়ে গেল।

এই সমস্ত অসদ্ব্যবহারের প্রতিবাদ করা ও দূরের কথা রাসুল (সাঃ) তাদের দিকে ভ্রূক্ষেপও করতেন না। তিনি সর্বদা নিবিষ্ট চিত্তে আল্লাহর ইবাদত বন্দেগীতে এবং সত্যধর্ম প্রচারে রত থাকতেন। তাঁর অসাধারণ ধৈর্য ও কষ্ট সহিষ্ণুতা দর্শন কবে কুরায়শগণ অবাক হয়ে থাকত।

স্থল বৃদ্ধিসম্পন্ন দুনিয়াদার জড়বাদী কুরায়শগণ মনে করল, ধন-সম্পত্তি ও প্রভাব প্রতিপত্তির লোভ ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্যে মানুষ এত কষ্ট সহ্য করতে পারে না। অতএব তারা নিজেদের প্রতিনিধিরূপে 'উতবাকে রাসূল (সাঃ)-এর নিকট প্রেরণ করল। 'উতবা তাঁর খিদমতে হাযির হয়ে বললঃ জনাব, আপনার প্রকৃত উদ্দেশ্য কি, তা আপনি আমাকে খুলে বলুন। আপনার হৃদয়ে যদি নেতৃত্ব করার স্পৃহা থাকে তবে আমরা আপনাকে সারা আরবের নেতারূপে গ্রহণ করতে প্রস্তুত আছি। আপনি যদি কোন উচ্চ বংশ সম্পৃতা পরমা সুন্দরী নারীকে বিবাহ করতে চান অথবা বিরাট ধনৈশ্বর্যের অধিকারী হতে চান, তবেতা পরিষ্কার করে বলুন। আমরা আপনাকে এসব কিছুই ব্যবস্থা করতে প্রস্তুত আছি। এমন কি আপনি যদি মক্কার সিংহাসনে উপবিষ্ট হয়ে আমাদেরকে আপনার আজ্ঞাবহ দাসরূপে দেখতে চান, তবে তাতেও আমরা সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত আছি। আপনি সারা আরবের 'আল-আমীন'। আপনার ন্যায় যোগ্য ব্যক্তিকে নেতা বা বাদশাহ্ বলে মেনে নিতে আমাদের কোনই আপত্তি থাকতে পারে না, কিন্তু দয়া করে আপনি আমাদের দেবতা ও পূর্ব পুরুষদের কুৎসা বর্ণনা করবেন না এবং আমাদের ধর্মের বিরুদ্ধে কিছুই বলবেন না। যদি আপনি আমাদের এই অনুরোধ রক্ষা করেন তবে আমরা যারপর নাই কৃতার্থ হব।

'উতবার বক্তব্য শ্রবণ করে রাসূল (সাঃ) হয়ত মনে মনে ভাবতেছিলেন, আমার ন্যায় তারাও ত সত্যের প্রতীক, তওহীদের মহাপ্রচারক হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর বংশধর এবং তারই রক্ত-মাংস হতে উদ্বৃত। তবে কেন তাদের হৃদয় এত হীন। 'উতবার প্রলোভন বাকা হতে স্পষ্টই প্রতীয়মান হচ্ছে যে, একমাত্র ধন দৌলত, প্রভাব প্রতিপত্তি এবং রমণী আসক্তিই তাদের জীবনের পরম ও চরম লক্ষ্য। স্বার্থপরতা ছাড়া তাদের নিকট আর কোন কিছুই মূল্য নেই। এহেন পশুতুলা নীচমনা জাতিকে মানুষের কাতারে আনয়ন করা এবং তাদের এই তিমিরাচ্ছন্ন অন্তঃকরণে হিদায়তের মশাল জ্বালিয়ে দেওয়া, আমার জন্য না জানি, কতই আয়াসসাধা হয়।

এমনিতেই উত্ত্বা ভাবতেছিল, আমার অনুরোধ তিনি হয়ত নিশ্চয়ই গ্রহণ করবেন। কারণ, এত বড় মর্যাদা লাভ করার কি কেউ কখনও অসম্মত হতে পারে? আজ আমি নিশ্চয়ই কুরায়শদের নিকট কৃতকার্য হয়ে ফিরব।

কিন্তু রাসূল (সাঃ) উত্‍ত্বার অনুরোধের উত্তরে পবিত্র কুরআনের এই আয়াতগুলো পাঠ করলেন-

"হে মুহাম্মদ (সাঃ) আপনি বলে দিন, আমি তোমাদেরই মত মানুষ, (পার্থক্য এতটুকু আছে যে) আমার প্রতি আল্লাহর এই ওহী অবতীর্ণ হয় যে, তোমাদের প্রভু একমাত্র আল্লাহ। (সমস্ত অলীক প্রভুসমূহ পরিত্যাগ করে) তোমরা সোজাসুচি তাঁর দিকে যাও (অর্থাৎ শুধু তারই ইবাদত কর) এবং পূর্বকৃত শিরক হতে তাঁর নিকটই ক্ষমা প্রার্থনা কর।"

(হে রসূল), আপনি বলে দিন যে, তোমরা কি আল্লাহ তা'আলার (একত্ব) অস্বীকার কর? যিনি দুই দিনের মধ্যে (এয় বড় প্রকাণ্ড) পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন; আর তোমরা কি তাঁর অংশী সাব্যস্ত কর? একমাত্র ইনিই বিশ্বজগতের প্রভু।

আয়াত দুটি শুনে 'উত্ত্বার মনের অবস্থা সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়ে গেল। সে ফিরে যেয়ে কুরায়শদেরকে বলল, "মুহাম্মদ (সাঃ) যে বাণী পাঠ করে শুনান তা কম্মিন কালে ও কবিতা নয়; এটা অন্য কিছু। আমার মতে তোমরা তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করা পরিত্যাগ কর এবং স্বাধীনভাবে তাঁকে ধর্ম প্রচার করতে দাও। তিনি যদি কৃতকার্য হয়ে সারা আরবের উপর অধিকার বিস্তার করতে পারেন তবে তাতে তোমাদেরই মর্যাদা বাড়বে। অন্যথায় আরবদের হাতে তিনি নিহত ও ধ্বংসপ্রাপ্ত হবেন কিন্তু কুরায়শগণ 'উতবার মত গ্রহণ করতে সম্মত হল না।

কি পায় অবলম্বন করলে যে মুহাম্মদ (সাঃ)-কে নিরস্ত করা যাবে এবং সত্যের প্রচার বন্ধ হবে, এ বিষয়ে তারা চিন্তা করতে লাগল। সকলেই দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হল যে, যে কোন প্রকারেই হউক, আমাদের ধর্ম এবং মুহাম্মদ (সাঃ)-এর আহবান্দে যেন কেউ সাড়া না দেয়, তার কোন কিছু একটা ব্যবস্থা করতেই হবে।


পরিশেষেঃ 

প্রিয় পাঠক, আজকের আর্টিকেলের মাধ্যমে আমরা বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর জীবনী সিরিজ পর্বের ১১তম পর্ব শেষ করেছি। এই সিরিজের ১২তম পর্বটি পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url